মস্তিষ্কের ‘প্রতারণা’ ও আমাদের বিচারশক্তির সীমাবদ্ধতা

কেউ যদি সবসময় সন্দেহে থাকে, যা দেখছে তা আসলে দেখছে কিনা, যা শুনছে ঠিক ঠিক শুনছে কিনা, যা ভাবছে ঠিক ভাবছে কিনা, তাকে আমরা স্রেফ উন্মাদ ঠাওরাবো, অথবা মাতাল, তাই না? নিজের বিচারশক্তি সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশি আস্থাশীল। পঞ্চেন্দ্রীয় ব্যবহার করে বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে পারা, স্মৃতিতে সেগুলো মোটামুটি নির্ভুলভাবে ধরে রাখতে পারা, যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে পারা, এসব বিষয় মানুষ হিসাবে জন্মগত ক্ষমতা হিসাবেই আমরা মনে করি। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক কিভাবে আমাদের ইন্দ্রিয়, স্মৃতি এবং বুদ্ধিমত্তাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে, আমরা তার কতটা জানি?
মানব মস্তিষ্ক সন্দেহাতীতভাবে অদ্ভুতরকম শক্তিশালী। তবে এই শক্তিশালী মস্তিষ্কেরও সীমাবদ্ধতা আছে। বিশেষ এক ধরনের সীমাবদ্ধতার কথা মনোবিজ্ঞানীরা সত্তুর দশকের দিকে প্রথম আবিষ্কার করতে শুরু করেন, যেগুলোকে প্রচলিতভাবে বলা হয় cognitive biases। এই সীমাবদ্ধতাগুলোর কারণে অনেকটা মনের অজান্তেই আমরা বিভিন্ন ধরণের অবাস্তব বিষয় বিশ্বাস করি, অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেই। Cognitive bias এর ভাল কোন বাংলা নেই, আমি একে বলছি মস্তিষ্কের প্রতারণা। অবচেতনভাবে আমাদের মনে ভুল ধারণার বীজ বুনে দেয়া মস্তিষ্কের প্রতারণা নয় তো আর কি?
তবে মস্তিষ্ক যে আমাদের সাথে মিছিমিছি প্রতারণা করে, সেটা ভাবা হবে একদম ভুল। আসলে মস্তিষ্ক আমাদের ভালর জন্যই, যেমন আমাদের সময় এবং শক্তি বাঁচাতে, নানা রকম কৌশল প্রয়োগ করে। বেশিরভাগ সময় এই কৌশলগুলো বেশ ভালভাবে কাজ করে, তবে মাঝে মাঝেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে, আর তখনই তৈরি হয় cognitive bias। cognitive bias এর আবার রকমফের আছে। কি উদ্দেশ্যে মস্তিষ্ক এসব কৌশল খাটায় , সেটা জানা থাকলে এই bias গুলোকে ধরে ফেলা একটু সহজ হয়।[১]
প্রথম উদ্দেশ্যঃ সীমাহীন তথ্যের ভান্ডার থেকে আপাতদৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো বেছে নেওয়া
আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত সীমাহীন তথ্য ভেসে বেড়াচ্ছে। এই তথ্যসাগরে হাবুডুবু খেয়ে না মরে বুদ্ধিমানের মত স্রেফ প্রয়োজনীয় তথ্যগুলোই যাতে আমরা নিতে পারি, সেজন্য আমাদের অতি বুদ্ধিমান মস্তিষ্ক বেশ কতগুলো সহজ পথ বের করেছে।
প্রথমত, একসাথে অনেক কিছুর ওপর মনোযোগ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই নিজের চোখে দেখেও আমরা অনেক কিছু দেখি না, শুনেও সবকিছু শুনিনা। এটাকে বলা হয় selective attention. নিচের ভিডিওটাতে ছোট্ট একটা পরীক্ষা আছে, চেষ্টা করে দেখুন তো পাস করতে পারেন কিন। selective attention test Daniel Simons Daniel Simons
অদ্ভুত, হাস্যকর এবং অসাধারণ ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক বা আকাঙ্ক্ষিত ঘটনার চেয়ে আমাদের বেশী চোখে পড়ে। মস্তিষ্ক এসব ‘অসাধারণ’ ঘটনাগুলোকে বেশী গুরুত্ব দেয়। এগুলোকে বলা হয় bizarreness effect বা humor effect। ধরুন একটা প্রচন্ড বিরক্তিকর সেমিনারে বসে আছেন, একের পর এক বক্তা ঘুমপাড়ানিয়া গলায় বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে একজন বক্তা কিছুক্ষন হাস্যরসিকতা করলেন। সারাদিন ঝিমিয়ে কাটালেও হাস্যরসের অংশটুকুতে আপনি কিন্তু নড়েচড়ে বসবেন। ওটুকুই আপনি খেয়াল করবেন।
আবার ধরুন আপনার বউ আপনাকে বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছে। আপনি সেটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। চাল, ডাল, হলুদ, মরিচ, ফেয়ার এন্ড লাভলি, আদা, রসুন। বাজারে গিয়ে ফর্দটি হারিয়ে ফেললেন। কোন জিনিষটার কথা সবচে বেশী মনে থাকবে আপনার? নিশ্চই ফেয়ার এন্ড লাভলি? কারণ এটা অন্য সবগুলো জিনিষের চেয়ে একেবারে আলাদা। একে বলা হয় isolation effect।
আমাদের আছে negativity bias। আমাদের প্রবণতা হচ্ছে যে কোন বিষয়ের নেতিবাচক দিকগুলোতে বেশী নজর দেওয়া, কারণ আমরা ধরে নেই ইতিবাচক ঘটনাগুলো ঘটাই উচিৎ। ধরুন আপনি এক জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, অনেকের কাছ থেকে অনেক ভাল কথা শুনেছেন, কিন্তু যেই একজন একটা খারাপ কিছু বলল, ব্যস, ওই জায়গায় যাওয়ার উৎসাহ মাঠে মারা গেল। তারপর ধরুন আপনার ছেলের স্কুলে গেলেন তার শিক্ষিকার সাথে দেখা করতে। তিনি আপনার ছেলে সম্পর্কে অনেক ভাল ভাল কথাই বললেন, শেষে শুধু বললেন, ওর মনোযোগটা আরেকটু বাড়াতে হবে। আপনি আগের সব ভাল ভাল কথা ভুলে গিয়ে শুধু এই কথাটাই ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে আসলেন। এরকম negativity bias এর ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে।
আমাদের আরেকটা প্রবণতা হচ্ছে কিছু সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে চট করে আমাদের মাথায় যেটা আসে, সেটার ওপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা। একটা উদাহরণ দেওয় যাক। পশ্চিমা বিশ্বে সামাজিক সমর্থন এবং আইনের শাসন থাকায় সেখানে মেয়েদের ওপর শারীরিক অত্যাচার, যেমন ধর্ষণের পুলিশি রিপোর্ট হয় বেশি, সেসব পরিসংখ্যান আমরা গণমাধ্যমে দেখিও বেশী। সে তুলনায় গরিব দেশগুলোতে, বিশেষত মুসলিম বিশ্বে সামাজিক সম্মানহানীর ভয়ে বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। তাই পৃথিবীর কোথায় মহিলাদের নিরাপত্তা কম, সে প্রশ্নে আমরা কেউ কেউ চট করে ভেবে ফেলি যে পশ্চিমা বিশ্বে ধর্ষণের হার বেশি মুসলিম বিশ্বের তুলনায়। কিন্তু আদতে মুসলিম বিশ্বে এই হার কত আমরা তা জানিই না। কিন্তু সেটা যে জানা দরকার এই তুলনার জন্য, এ বিষয়টাই আমাদের মাথায় আসে না। আমাদের মাথায় আসে পশ্চিমা বিশ্বের পরিসংখ্যান, আর আমরা ভাবি গুরুত্বপূর্ণ বলেই এটা আমাদের মাথায় এসেছে। এ ধরণের ভ্রান্তিগুলোর কারণ হল availability heuristic। এই ভুলের কারণে আমরা আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে, বা যেসব তথ্য আমরা মনে করতে পারি, সেগুলোকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেই। যে তথ্যগুলো নেই সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাই না। এধরণের আরো অনেক bias আছে, যেমন শুধুমাত্র চেনাজানা, সেকারণে কোন কিছুর প্রতি পক্ষপাতগ্রস্থ হয়ে পড়া, যাকে বলা হয় mere exposure effect। আবার যেসব বিষয় নিয়ে আমরা বেশী ভাবি (যেমন মেয়েদের শাড়ী আর ছেলেদের গাড়ী) সেগুলোই আমাদের বেশী বেশী চোখে পড়ে attentional bias এর কারণে।
আরেকটি অতি পরিচিত bias হচ্ছে confirmation bias। আমরা যা বিশ্বাস করি, সেগুলোর পক্ষে যে সব প্রমাণ আছে আমরা অবেচেতনভাবেই সেগুলো লক্ষ্য করি আর সেগুলোর বিপক্ষের প্রমাণগুলো এড়িয়ে যাই। যেমন আমরা যদি বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি দুর্বল থাকি, পত্রিকায় তাদের সম্পর্কে কোন নেতিবাচক খবর আসলে আমরা সেদিকে চোখই ফেরাবো না। সে সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলব। যে পত্রিকা আমার দল সমর্থন করেনা, সেটা বাড়িতে রাখবই না। দলের পক্ষের পত্রিকার প্রতি রাখব অগাধ বিশ্বাস। ফলে আমাদের দল আদতে মন্দ না ভাল সেটা ইহজীবনে জানতে পারব না। আবার ঝোঁকের মাথায় কোন একটা বাজে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে আমরা আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বের করি সিদ্ধান্তটার ভাল দিক কি কি। শেষ পর্যন্ত নিজের কাছে প্রমাণ করে ছাড়ি কেন সিদ্ধান্তটা ভাল ছিল। এধরণের প্রবণতাকে বলা হয় choice-supportive bias। আমাদের চালাক মস্তিষ্ক আরো কত কিই না করে। বাংলায় একটা কথা আছে না, যারে দেখতে নারে তার চলন বাঁকা? এটা খুব সত্যি। আমরা যাদের কোন কারণে পছন্দ করি, তাদের সব কিছুই আমাদের ভাল লাগে অথবা তাদের দোষগুলো খুব একটা চোখে পড়ে না, কিন্তু যাদের কোন কারণে পছন্দ করিনা, তাদের সবকিছুতেই দোষ খুঁজে পাই। এই বিষয়টাকে বলা হয় halo effect। মোট কথা, আমাদের এধরণের একপেশে স্বভাবের কারনে আমরা সহজে আমাদের ভুল ধারণা বা বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনা, অনেক ক্ষেত্রে কখনোই পারিনা।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্যঃ অর্থহীন জগতে অর্থ খুঁজে পাওয়া
মানুষের একটা মৌলিক বৈশিষ্ট হচ্ছে সবকিছুর অর্থ খুঁজতে যাওয়া, কার্যকারণ বুঝতে চাওয়া, জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে চাওয়া। এই জীবনের অর্থ কি, সেটা তো আমাদের সভ্যতা, সমাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের একটা কেন্দ্রীয় প্রশ্ন, তাই না? মোটকথা আমরা মানুষেরা অনিশ্চয়তা ভালবাসিনা। কিন্তু আমাদের জগত অজানা সব রহস্যে পূর্ণ গোলমেলে এক জায়গা। এই জগতের অতি সামান্য অংশই মানুষের গোচরে আসে। এখানে অর্থ খুঁজে পাওয়া, কার্যকারণ বোঝা আর নিয়ন্ত্রন আনা খুব কঠিন। তাই মস্তিষ্ক চেষ্টা করে বিভিন্ন তথ্য বা ধারণা একটার সাথে আরেকটা জুড়ে অর্থ দাঁড় করাতে, আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য কারণ আবিষ্কার করতে। তাতে আমাদের অনিশ্চয়তা হয়ত কাটে ঠিকই, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বাস্তব নির্ভর হয়না।
যেমন আমরা প্রায়ই দুটি অসম্পর্কিত বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক বের করে ফেলি। আমাদের নানী-দাদীরা প্রায়ই বলেন অমাবস্যায় নাকি তাদের বাতের ব্যথাটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আবার পূর্ণিমার রাতে নাকি পাগলের পাগলামি বেড়ে যায়। এসব আমাদের কাছে এখন হাস্যকর মনে হয়। তবে আমরাও কম যাইনা। এখনো কত লোক রাশিফলে বিশ্বাস করে ভেবে দেখুন। কত লোক ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে হাতে হাতে ফল পায়! এই ধরনের সব ক্ষেত্রেই যেটা হয় সেটা হচ্ছে, যখন বিষয়টা মিলে যায়, তখন আমরা ঠিকই খেয়াল করি, যখন মেলে না, সেটা আমাদের চোখেই পড়ে না। বিশ্বাসীর প্রার্থনার বিষয়টাই ধরুন। বেশীরভাগ সময় প্রার্থনায় আসলে কোন কাজ হয়না, তাই সেটা লক্ষ্য করার মত কোন বিষয় না। কিন্তু যেই মিলে গেল কাকতালীয়ভাবে, তখনি সে মনে করবে, ঈশ্বেরের ইচ্ছাতেই হয়েছে! এই বিষয়গুলোকে বলা হয় Illusory correlation, মানে কাল্পনিক কার্যকারণ আবিষ্কার করা।
আবার অনেক সময় আমরা খুব সামান্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা কাহিনি ফেঁদে বসি বা ‘সূত্র’ আবিষ্কার করে ফেলি। ভিন্ন জেলা, ভিন্ন দেশ বা জাতি নিয়ে কটুক্তি করা আমাদের একটা দোষ। আমরা প্রায়ই বড় গলা করে বলি, অমুক এলাকার লোক একেবারে যা তা। একটু জেরা করলেই বের হয়ে যাবে আমাদের এহেন আপত্তিকর দাবির পেছনে আছে সে এলাকার বড়জোর দুই একজন লোকের সাথে আমাদের অভিজ্ঞতা! আর তাতেই আমরা নিয়ে ফেলি এত বড় সিদ্ধান্ত। আবার আপনি ভাল ভেবে কোন মদ্যপায়ীকে বোঝাতে যান নেশার ক্ষতি সম্পর্কে, দেখবেন সে আপনাকে উলটো বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তার অমুক কাকা সারা জীবন মদ খেয়ে পঁচাশি বছর বেঁচে ছিল, অতএব মদ খেলে কিছু হয়না! এগুলো সবই Anecdotal fallacy, অর্থাৎ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা বিচ্ছিন্ন উদাহরণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া, যুক্তির ভিত্তিতে নয়।
১৯৬১ সালে Milgram experiment নামে বিখ্যাত একটা মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষা হয়েছিল। রাস্তা থেকে ডেকে আনা সাধারণ মানুষদের বলা হল পর্দার আড়ালে বসে থাকা একজন মানুষকে কিছু প্রশ্ন করতে আর ভুল উত্তর পেতে থাকলে উত্তরদাতাকে ক্রমান্বয়ে উচ্চমাত্রার বৈদ্যুতিক শক দিতে। তাদেরকে বলা হল, ওপাশের মানুষটি যত জোরেই চিৎকার করে উঠুক অথবা অজ্ঞান হয়ে যাক, তবু শক চালিয়ে যেতে। দেখা গেল, বেশিরভাগ লোকই শেষ পর্যন্ত শক দেওয়া চালিয়ে গেছে। কারণ? যারা তাদেরকে এটা করতে বলেছিল তারা ছিল সাদা চুলের সাদা কোট আর মোটা চশমা পড়া বিজ্ঞানী, যাদের কথা বিশ্বাস করা চলে! এধরণের প্রবণতাকে বলা হয় authority bias। Milgram experiment অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে এটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে আমরা যাদের সম্মান করি, গুরু হিসাবে মানি, ঈশ্বর বা কর্তা মনে করি, তাদের ওপর বিশ্বাস রেখে আমরা কত কিই না করতে পারি। ধর্মগুরুর ভরসায় কত মা তার সন্তানকে বিনা চিকিৎসায় মারলেন, কমান্ডারের কথা মেনে কত কিশোর সৈনিক অমানুষ হয়ে উঠল যুদ্ধ ময়দানে, কত হাজার বছর ধরে কত কোটি নিম্নবর্ণের হিন্দু ঈশ্বেরর বিধান বলে মেনে নিলেন তাদের প্রতি সমাজের নিদারুন অবিচার? ধর্মে আছে, বাবা বলেছেন, অমুক বইতে আছে, তমুক জ্ঞানীর অভিমত, এই বিচারে আমরা কত কথার সত্যতা বা ন্যায় অন্যায় বিবেচনা করতে ভুলে যাই, একটু ভেবে দেখুন তো।
Milgram experiment নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি এখানে দেখতে পারেন। The Milgram Experiment 1962 Full Documentary
তৃতীয় উদ্দেশ্যঃ দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করা
আমাদের প্রতিনিয়ত ছোট বড় নানা রকম সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সব প্রয়োজনীয় তথ্য প্রায় কখনোই আমাদের কাছে থাকে না, বা থাকলেও সেগুলো সব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত সময় থাকেনা। তাই মস্তিষ্ক অনেকগুলো রাস্তা বের করেছে।
অনিশ্চিত অবস্থায় একটা সিদ্ধান্তে আসতে হলে আমাদের নিজেদের ক্ষমতার প্রতি আস্থা রাখাটা খুব জরুরি, সেটা বুঝে মস্তিষ্ক অনেক সময় কৃত্রিমভাবে আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, মানুষের কোন একটা অবস্থায় যতটা নিয়ন্ত্রণ থাকে, নিজের প্রতি তার আস্থা থাকে তারচেয়ে বেশী। এর ফলে মানুষ নতুন তথ্য জোগাড় করা বা নতুনভাবে বিশ্লেষণ করার কষ্টটুকু করতে চায় না । একে বলা হয় Overconfidence effect। একই ধরণের আরেকটা bias হচ্ছে optimism bias, যার ফলে মানুষ বিশ্বাস করে নিজের বা নিজের পরিবাররের ওপর যেকোন ধরণের ঝুঁকি সাধারণের তুলনায় কম। আবার আমাদের সিদ্ধান্তের ফলাফল যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে তার কৃতিত্বটুকু আমরাই নিতে চাই, কিন্তু যদি নেতিবাচক হয় তাহলে খুব দ্রুত আমরা অন্য কিছুর ওপর দোষ চাপিয়ে দেই। এটাও এক রকম bias, যার যুতসই নাম হচ্ছে Self-serving bias।
দোকানে গিয়ে দর কষাকষির সময় প্রায়ই এমন হয়না যে বিক্রেতা যে দাম হাঁকল তার থেকে কত কমে আমরা জিনিষটা কিনতে পারলাম, সেটা হিসাব করেই আমরা বেজার বা খুশি হই? সাধারণত আমরা কিন্তু নিরপেক্ষভাবে ভাবতে পারিনা জিনিষটার দাম আসলে কত হওয়া উচিৎ। এই ধরণের bias কে বলা হয় anchoring bias, তার মানে প্রথম যে তথ্যটা পাওয়া যায় সেটাকে ভিত্তি করে পরবর্তি তথ্যের গুন বিচার করা। চাকরির দরকষাকষির ক্ষেত্রে অনেকে এই বোকামিটা করে থাকে। চাকরিদাতা একটা হাস্যকর রকম বেতন প্রস্তাব করে, আর আমরা সেই প্রস্তাব থেকে কিছুটা ওপরে উঠতে পারলেই বর্তে যাই। বুদ্ধিমান লোকেরা কিন্তু এই ভুলটা করেনা, তারা ইন্টারভিউএর আগেই গবেষণা করে নেয় বেতনটা আসলে ঠিক কত হওয়া উচিত।
আমাদের আরেকটা প্রবণটা হচ্ছে ভবিষ্যতের চেয়ে বর্তমানকে বেশী গুরত্ব দেওয়া। ওজন কমাতে ব্যায়াম করার কথা, তা না করে টিভির সামনে বসে আইস্ক্রিম খাওয়া, টাকা জমিয়ে বছরখানেক পরে বিদেশ ভ্রমণে যাওয়ার ইচ্ছে, কিন্তু প্রতি মাসে সে টাকা রেস্তোরাঁয় খেয়ে উড়িয়ে দেওয়া, ফুসফুস বাঁচাতে সিগারেট ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করে রোজ সে প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গা, এ জাতীয় ঘটনা আমাদের সবার জীবনেই ঘটে। অর্থনীতির ভাষায় এই প্রবণতাটার নাম হচ্ছে Hyperbolic discounting। তার মানে হচ্ছে বর্তমানের চেয়ে ভবিষ্যতের লাভ ক্ষতি দুটোই ছোট করে দেখা। আসলে ভবিষ্যতের ভাল ভেবে বর্তমানে কিছু ত্যাগ করার জন্য নিজের ওপর মানুষের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন। এই আত্ম নিয়ন্ত্রণ মানুষের জন্য, বিশেষত মস্তিষ্কের জন্য বেশ কঠিন। তাই মস্তিষ্ক এই চালাকিটা করে। একইভাবে, মাথাকে যাতে বেশী খাটতে না হয় সেজন্য আমরা প্রায়ই জটিল কাজগুলো ফেলে রেখে তুলনামূলক সহজ কাজগুলোকে করতে থাকি, এমনকি তখনও যখন সহজ কাজ গুলো না করলেও চলে কিন্তু জটিল কাজগুলো করাই জরুরী। আমরা নিজেদেরকে মনে মনে বুঝ দেই যে সহজ কাজগুলো করাও জরুরী!
যে কাজটা কিছুদূর করে ফেলা হয়েছে, সেটার আর প্রয়োজন না থাকলেও আমরা সেটা চালিয়ে যাই, এটা এক ধরণের বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। রেস্তোরাঁয় গিয়ে একটা বাজে খাবার অর্ডার করা আর খাবার নষ্ট হবে সে ভয়ে পুরোটা খেয়ে নেওয়া, টিকিট কেনার পর কনসার্টের দিন জ্বর-সর্দি হওয়া সত্বেও টাকা জলে যাওয়ার ভয়ে কনসার্টে গিয়ে আরো কষ্ট করা, একটা বাজে ছবি অর্ধেক দেখে ফেলা হয়েছে, সে কারণে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বাকিটা দেখা, এগুলোর কোন মানে হয়না, তাইনা? কিন্তু আমরা মাঝে মাঝেই এমন করি, যেন কাজটা শেষ করতে পারলে আগের ক্ষতিটা কোনভাবে পুষিয়ে নেওয়া যাবে। মনোবিজ্ঞানীরা আমাদের এই বোকামির নাম দিয়েছেন Sunk cost fallacy।
তাই আমাদের সিদ্ধান্ত, বিশেষত দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রায় সময়ই যুক্তিযুক্ত হয়না, মাঝে মাঝে সেগুলো নিজেদের জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে এধরণের cognitive bias এর কারনে।
চতুর্থ উদ্দেশ্যঃ মনে রাখার কাজটা সহজ করা
আমাদের আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা কি কি মনে রাখব। একবার ভাবুন তো, প্রতি বেলায় কি খাবার খেয়েছেন, কি রঙের পোষাক পরেছেন, কত নাম না জানা মানুষের মুখ দেখেছেন আর পত্রিকার পাতায় কত রকম খবর পড়েছেন, এই সব যদি আপনাকে মনে রাখতে হত, তাহলে কি অবস্থাটাই না হত। এই সমস্যার মোকাবিলা করতে মস্তিষ্কের অনেকগুলো কৌশল আছে।
প্রথমত আমরা সাধারণত কোন বিষয় বিস্তারিত মনে রাখিনা, সারাংশটকু মাথার হার্ড-ড্রাইভে ভরে নিই শুধু। অনেক বিষয়ের সারাংশ করা কঠিন, সেক্ষেত্রে শুধু উল্লেখযোগ্য অংশগুলো মনে রাখি। স্কুলের স্মৃতি মনে করুন তো। দেখতে সাধারণ, মধ্যম মানের ছাত্র, ভদ্র, এবং বেরসিক কতজনের কথা মনে আছে আপনার? কিন্তু ক্লাসের ফার্স্ট বয়, সেই সুন্দরী মেয়েটি অথবা ক্লাসের সবচে ফাজিল ছোকড়াটির কথা কিন্তু ঠিকই মনে আছে, কারণ তাদেরকেই আপনি খেয়াল করেছিলেন। isolation effect এর ফলেই এটা হয়েছে।
আমরা যেহেতু কোন বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য প্রায় কখনোই পাইনা, তাই আমাদের মস্তিষ্ক সামান্য তথ্য থেকে পুরো বিষয় ‘পুনঃনির্মান’ করতে পটু হয়ে গেছে। কিন্তু যেটা হয়, এই খন্ডিত ছবিগুলোকে সম্পূর্ন করতে যেয়ে সেখানে অনেক রকম ভেজাল ঢুকে পড়ে। এক স্মৃতির সাথে আরেকটা গুলিয়ে যায়, যে জিনিষটা একটা স্মৃতিতে ছিলনা, সেটা সেই স্মৃতির অংশ হযে পড়ে। এরকম তো প্রায়ই হয়, আপনি একটা ঘটনার কথা বলছেন যেখানে আপনার বন্ধু উপস্থিত ছিল আর আপনার বন্ধুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছে। আপনারা দুজনেই দিব্যি কেটে বলছেন যে যার যার কথাই ঠিক! এখানে কেউ একজন যে মিথ্যে বলছে সেটা নাও হতে পারে, কারো একজনের অথবা দুজনের স্মৃতিতেই ভজঘট লেগে যাওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।
আবার অনেক সময় অন্যের কাছ থেকে কোন একটা ধারণা পেয়ে সেটা আমরা স্মৃতিতে রাখি ঠিকই, কিন্তু কার কাছ থেকে জেনেছি সেটা বেমালুম ভুলে যাই। ফলে আমাদের মনে হতে পারে, ওই ধারণাটা নিজেরই আবিষ্কার! মনোবিজ্ঞানীরা এই বিষয়টার যথাযোগ্য একটা নাম খুঁজে পেয়েছেন। Cryptomnesia। অনেক সময় এক ঘটনার চরিত্র পালটে সম্পূর্ণ অন্য চরিত্রের আগমন ঘটাই। এটা এক ধরণের source confusion।
আগেই বলেছি, আমাদের প্রবণতা হচ্ছে কোন বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ ছেঁটে ফেলে শুধু মূল বা উল্লেখযোগ্য অংশগুলো স্মৃতিতে জমা রাখা। এতে আমাদের মাথা ভারাক্রান্ত হয়না, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এর মূল্য আমরা দেই আমাদের কূপমন্ডকতায়। যেমন ধরুন, আমরা সাধারণত বিভিন্ন জাতীয়তা, বর্ণ, লিংগ, বয়স, পেশা, ইত্যাদি সম্পর্কে আপাতদৃষ্টিতে কিছু লক্ষনীয় বৈশিষ্টগুলো মনে রাখি। যেমন, ইংরেজরা রসকসহীন, ব্যবসায়ীরা চালবাজ, মেয়েরা দুর্বল, কালোরা অপরাধপ্রবণ, আরবরা অসভ্য, ইত্যাদি ইত্যাদি। একে বলা হয় stereotyping। এধরণের মোটাদাগের ধারণা আমাদের চোখে রঙ্গীন চশমা পরিয়ে দেয়। একজন মানুষের সাথে পরিচয় হওয়ার আগেই আমরা তার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, সে আসলে কেমন এ বিষয়ে আর নিরপেক্ষভাবে ভাবতে পারিনা।
যেহেতু মানুষ সাধারাণত উল্লেখযোগ্য বা বিশেষ বিষয়গুলো খেয়াল করে, আর তাই সেগুলো মনেও থাকে। দেখা যায়, কোন একটা বিশেষ অভিজ্ঞতার চরম মুহূর্তগুলো আমাদের মনে থাকে বেশী। এধরনের প্রবণতার নাম হচ্ছে Peak–end rule। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে আমরা কতক্ষন কাজের কাজ করি সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা। কাজ করতে আমাদের বেশিরভাগেরই ভাল লাগে না। তাই কাজ করার যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি আমাদের খুব ভাল মনে থাকে।ফলে আমরা ভাবি আমরা বুঝি সারাক্ষন কাজই করি। কিন্তু একটা দিন প্রতি দশ মিনিটে কি কি করলেন সেটা টুকে রাখুন, দেখবেন আপনার ধারণার চেয়ে কত কম সময় আসলে আপনি কাজ করেছেন! এর উল্টোটাও আছে। অনেকেই দেখবেন অতীত নিয়ে ভীষণ রকম রোমান্টিক হয়ে যায়। তাদের কাছে হারানো অতীতটা খুব সুখের আর আজকের দিনটা বিরক্তিকর। আসলে তারা অতীতের তীব্র সুখের স্মৃতিগুলোই মনে রাখে, রোজকার একঘেয়ে বিরক্তিকর অভিজ্ঞতাতো মনে রাখার তো কিছু নেই! তাই অতীত সাধারণত বর্তমানের চেয়ে সুখকর!
এখানে মাত্র কয়েক রকমের cognitive bias নিয়ে কথা বলা হলো, আরো হাজারো রকমের cognitive bias আছে। এসব দূর্বলতা থেকে আমরা সম্পূর্ণভাবে কখনোই বেরিয়ে আসতে পারবা না, তাহলে আমরা অতিমানব হয়ে যাব। তবে এতক্ষণ এত রকম bias এর কচকচানি শুনে আমাদের কি লাভ হল? আমরা অন্তত জানলাম যে আমরা সব কিছু দেখিনা, আমাদের স্মৃতিশক্তি ততটা বিশ্বাসযোগ্য নয় আর আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে আরেকটু চিন্তাভাবনা করা উচিত। আর cognitive bias সম্পর্কে কিছুটা জানলাম বলেই সেগুলো থেকে আমরা বেরোনোর চেষ্টা অন্তত করতে পারব। না জানলে সেটাও সম্ভব হত না।
আমরা নিজেদের cognitive bias গুলো দেখতে পাইনা। সেটাও এক ধরণের bias! চলুন না এখান থেকেই শুরু করা যাক!
[১] উদ্দেশ্য অনুযায়ী cognitive bias গুলোকে ভাগ করার ধারণাটা নেওয়া হয়েছে cognitive bias cheat sheet ব্লগ থেকে।Advertisements