ফর্সা রঙের ইতিবৃত্তঃ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে
কাছের লোকেরা বলে আমি নাকি শ্যামলা। আসলে বাংলাদেশের মানদন্ডে আমি কালই (এই মানদন্ড অনুযায়ী অবশ্য বাংলাদেশের বেশিরভাগ লোকই কালো!)। আমার ছোটবোনও প্রায় আমার মত। আমাদের আম্মা বেশ ফরসা তবে আব্বা কালো। ছোটবেলায় অনেকেই আম্মাকে সহানুভুতির সুরে বলতেন, ভাবি আপনি এত সুন্দর আপনার মেয়েগুলো যে কেন কালো হল| পাঁচ বছর আমেরিকায় থেকে দেশে ফেরার পর অন্তত ১০ জন আমাকে বলেছে আমি নাকি আরো কালো হয়ে গেছি, যেখানে আমেরিকায় যেয়ে মানুষের ফর্সা হওয়ার কথা!!! কি দুক্ষজনক!!! মানুষের কথায় আমি কখনই কিছু মনে করতামনা। আমার আব্বা-আম্মার কোন দুঃখ ছিল কিনা দুটি কালো মেয়ে পেয়ে, তা কখনও জানার সুযোগ হয়নি। আমরা পড়াশুনায় বেশ ভাল ছিলাম, পাশ করেই মোটামুটি সম্মানজনক চাকরি পেয়েছি আর সময়মত উপযুক্ত বর পেয়েছি। তাই আমাদের রঙের কারণে তাদের কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি।
তবে আস্তে আস্তে বুঝতে শিখলাম যে, ফর্সা ত্বকের প্রতি আমাদের এই অপরিসীম দুর্বলতা আসলে ঠিক মানুষের সংকীর্ণতা বা হীনমন্যতার পরিচয় নয়। এটা সত্যি যে প্রাজ্ঞজনেরা এই দুর্বলতাটা থেকে প্রায়ই বেরিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ কিছুতেই পারেনা। এই দুর্বলতার কারণগুলো নৃতাত্বিক এবং ঐতিহাসিক। এমনকি বিবর্তন তত্ব ব্যবহার করেও এই দুর্বলতা ব্যাক্ষা করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যদের আগমন শুরু হয় আজ থেকে ৩৫০০/৪০০০ বছর আগে। আর্যরা ভারত দখল করে নিয়েছিলো নাকি শান্তিপূর্ণ বসতি গেড়েছিল, এবিষয়ে ইদানিং বেশ ভাল বিতর্ক শুরু হয়েছে। সে বিতর্কে না যাওয়াই ভালো। তবে আর্যরা যে উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌছে গিয়েছিলো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর্যরা ছিল মধ্য এশিয়ার বংশোদ্ভুত। তারা ছিল ফর্সা। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ভেতরে ফর্সা রঙের তুলনামূলক মাত্রাধিক্য থেকে অনুমান করা যায় যে, আর্যরা তাদের বংশধারা বেশ ভালভাবেই সংরক্ষণ করে রাখছে এই হাজার হাজার বছর ধরে। সাম্প্রতিক এক গবেষোনায় দেখা গেছে, ইউরোপিয়দের রং ফর্সা করার পেছনে যে জিন আছে, সে একই জিন এলাকা নির্বিশেষে ভারতের ব্রাক্ষণদের ভেতরেও ব্যপাকহারে উপস্থিত। তো আর্যদের পর কারা এলো? মুঘলরা। মুঘলরাও এসেছিল মধ্য এশিয়া থেকে, তারাও ছিল ফর্সা। সব শেষে এল ইংরেজরা, খাঁটি সাদার জাত। তো হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে সাদার জয়জয়কার, তারাই শাসক, তারাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক, তারাই সর্বশক্তিমান। আর কালোরা নীচুজাত, শাসিত, শোষিত, শক্তিহীন। (এখানে বলে রাখা ভাল, ইতিহাসের এই বিষয়গুলো মোটেই সাদাকালো নয়, অনেক বৈচিত্র রয়েছে, তবে আমি একটা মোটামুটি সাধারণ প্রবণতার কথা বলছি। আর প্রাকৃতজনের ইতিহাস যতটুকু আমরা জানি, তাতে এটুকু অন্তত বলা যায়, তারা নিজেদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বল্পতার কারণে আর্যদের কাছে বশ মানেনি, কারণটা ছিল মূলত রাজনৈতিক)। এমনকি পরবর্তিতে উপমহাদেশে তথাকথিত সাম্যের ধর্ম ইসলামের প্রসারের সময় এই সাদা কালোর বিভেদ তো মিটলই না বরং আরো বাড়ল। বহু নিম্নবর্ণীীয় হিন্দু মুক্তির আশায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো। তবে পরিহাস হল এই যে তাদের মর্যাদার কোনো পরিবর্তন হলনা। তারা হল ‘আতরাফ’ বা নিম্নবর্নীয় মুসলমান। আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে আশা সাদা, শারীফ মুসলমানরা হল ‘আশ্রাফ’ বা উচ্চবর্গীয় মুসলমান।
তাই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সাদা রং হয়ে উঠলো আভিজাত্য আর ক্ষমতার প্রতীক, আর কালক্রমে সেটা হয়ে উঠলো সৌন্দর্যের মানদন্ড। কেন? কারণ, নরনারীর সৌন্দর্যের মাপকাঠি আসলে প্রচন্ডভাবে বিবর্তন-নির্ভর। বিবর্তন মেয়েদের শিখিয়েছে সুঠামদেহী পুরুষের প্রেমে পড়তে, কারণ প্রাচীনযুগে সেধরণের পুরুষ বন্য প্রকৃতি মুকাবিলায় সামর্থ ছিলোে। সুঠামদেহী পুরুষের ঔরসজাত সন্তানও সেসব গুণ পায়, তাতে সেসব সন্তানের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও হয় বেশী। পুরুষেরা ভারী নিতম্বযুক্ত নারীর প্রেমে পড়তে লাগল, কারণ নিতম্ব ভারী হলে বাচ্চা জন্ম দিতে সুবিধা হয়। এহলো আদিম যুগ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকদের ধারণা।
তো মানুষের সভ্যতার বিকাশের সাথেসাথে সৌন্দর্যের সংজ্ঞায় নিতান্ত জৈবিক তাড়নাভিত্তিক মৌলিক শারীরিক বৈশিষ্টের সাথে যুক্ত হতে লাগল রাজনৈতিক, সামাজিক এবং, বিশেষত অর্থনৈতিক ক্ষমতাভিত্তিক নানা রকম শারীরিক বৈশিষ্ট, যেগুলোর জৈবিক বংশগতি রক্ষায় কোন ভূমিকা নেই, কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট সভ্যতায় ভালভাবে বেঁচে থাকার ইঙ্গিত বহন করে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল গায়ের রং। ভারতীয় উপমহাদেশে রং ফর্সা হয়ে উঠলো উচ্চবংশ, ধন-সম্পদ আর ক্ষমতার প্রতীক। তাই ফর্সা রং মানেই সুন্দর, আর কালো হলওে ময়লা।
যদিও উপমহাদেশে ফর্সা রঙের প্রতি দুর্বলতাকে টেক্কা দিতে পারবেনা কেউই, তবে এটা কমবেশি সর্বত্র বিরাজমনা। আফ্রিকায় সাদা রঙের প্রচন্ড আদর। আফ্রিকায় সাম্প্রতিককালের ইংরেজ, ফরাসী এবং ডাচ শাসকরা তো সাদা ছিলো বটেই, এর আগে হাজার হাজার বছর ধরে আরবরা আফ্রিকা থেকে কালো দাস কিনে নিয়ে গেছে। পুরো দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে স্প্যানিশ এবং পর্তুগীজ সাদারা আজোও অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, আর শ্যামা আদিবাসীরা রয়ে গেছে দরিদ্র, নিগৃহীত। তাই সেখানেও সাদা রং খুব সুন্দর। ইদানিং নাকি চীন দেশের হলুদ মেয়েরা একেবারে গোলাপী সাদা হবার সাধনায় মেতেছে। এর কারণও একই। সাদাদের অর্থনৈতিক বিশ্ববিজয়।
বিশ্বব্যাপী সাদাদের হাজার হাজার বছরের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব সৌন্দর্যের সংজ্ঞায় একটা মৌলিক মানদন্ড যোগ করেছে, সাদা রং। তাই এর থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। এমনকি প্রচুর শিক্ষিত ও রুচিশীল মানুষও সাদা রঙের কাছে হার মেনে যায়। কারণ এর সাথে শিক্ষাদীক্ষার খুব বেশি সম্পর্ক নেই। সাদা রঙের প্রতি দুর্বলতাটা গত দুই তিন হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে আমাদের জিনে চলে এসেছে। তাই কেউ ফর্সা রঙের পূজা করলে তাকে নিছক কূপমণ্ডূক এবং ছোটো মনের অধিকারী বলে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই, সে আসলে অনেকটাই তার জিনের হাতে বন্দি।
সবশেষে আসা যাক, এই গায়ের রঙের দায়ভারটা মেয়েদের ওপর কেন সবচেয়ে বেশি বর্তায়। এটাও মূলত অর্থনৈতিক। বেশিরভাগ সমাজেই এখনো অর্থনীতিতে পুরুষের জয়জয়কার। পুরুষেরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। নারীরা সন্তান পালনের বোঝা নিয়ে থাকে, আর পুরুষেরা জয় করে নেয় বাইরের দুনিয়া। অর্থনীতি। তাইতো কথায় বলে, ছেলে তো ছেলেই, কানা আর খোঁড়া। কিন্তু মেয়েদের তো সে জোর নেই। ইদানিং মেয়েরা বাড়ির বাইরে এসে কাজ করছে ঠিকই, কিন্তু সেটা শুরু হল এইতো সেদিন। এখনো মেয়েদের মূল যোগ্যতা বিবেচনা করা হয় সৌন্দর্য দিয়ে, আর তার প্রধাণ মাপকাঠি হল গায়ের রং। অবচেতনভাবে মানুষের মনে এখনো কাজ করে গায়ের রং ফর্সা মানে মেয়ের বংশ ভাল, মেয়ে আর কিছু না পারুক উন্নত জিন তো যোগ করতে পারবে বংশধারায়।
তাই যতই আমরা চিৎকার করে মরি না কেন, গায়ের রঙে দিয়ে মেয়েদের সৌন্দর্য বিচার অত্যন্ত অন্যায় ও রুচিহীন, এর বিলুপ্তি কিছুতেই হবেনা। এর বিলুপ্তি সেদিনই হবে, যেদিন সব নারী পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রমাণ করবে তার অর্থনৈতিক যোগ্যতা। এখনো কি সে সময় হয়নি?