November 27, 2016

‘স্বাধীন ইচ্ছা’র সোনার হরিণ এবং আমাদের সহমর্মিতা

‘স্বাধীন ইচ্ছা’র সোনার হরিণ এবং আমাদের সহমর্মিতা

অসম্ভব স্পর্শকাতর একটা বিষয় দিয়ে শুরু করছি। সম্প্রতি পাঁচ বছরের একটি কন্যাশিশুর ভয়ংকর যৌন নির্যাতনের খবর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে আলোড়ন তুলেছে। খবরটা দেখে আমরা সবাই শিউরে উঠেছি। বিকৃত যৌনাকাঙ্খার ভয়ঙ্করতম প্রকাশ আমাদের বিচলিত করেছে। আমাদের মনে হয়েছে, যে লোকটা এই জঘন্য কাজটা করেছে, সে কি মানুষ না পশু? লোকটার ছবি দেখে রাগে, ঘেন্নায় আমাদের মন কুঁকড়ে গেছে। অনেকেই নানা রকম নিষ্ঠুর শাস্তির প্রস্তাব করেছে এই পাষণ্ডটাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে। শুধু এ ঘটনাটাই না, শিশু যৌন নির্যাতনের কথা শুনলেই আমাদের মনে সবসময় প্রশ্ন জাগে, কেন? একজন মানুষ কতটা নীচ আর বিকৃতমনা হলে এধরনের কাজ করতে পারে? কিন্তু ধরুন আমরা যদি জানতে পারি, শিশু যৌনাকাঙ্খা অন্য যে কোন মানসিক রোগের মতই একটা রোগ? অথবা সমকামিতার মত এটাও একটা মানসিক প্রবণতা, যেটার ওপর আসলে মানুষের নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই? কিম্বা যদি জানতে পারি যে দোষী লোকটা ছেলেবেলায় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল নিজেই, আর তার প্রভাব পড়েছে তার মনে? তাহলে কি একজন শিশু যৌন নির্যাতনকারীর ওপর আমাদের এতটা বিবমিষা জাগবে?

প্রথমে বলে নেই, শিশু যৌন নির্যাতন আর শিশু যৌনাকাঙ্খা বিষয়দুটো এক নয়। অনেক মানুষ সারা জীবন শিশুদের প্রতি যৌনাকাঙ্খা অনুভব করে, কিন্তু কখনই তা প্রকাশ করেনা। বিষয়টা এতটাই স্পর্শকাতর যে অনেকেই নিজেদের এই প্রবণতাটা বুঝতে পেরে গোপনে আত্মগ্লানির ভার বয়ে বয়ে সারাটা জীবন কটিয়ে দেয়। কানাডাতে শিশু যৌনাকাঙ্খা বিষয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। এর মধ্যে ডক্টর জেমস ক্যান্টররের কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কানাডার এই বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী গত বারো বছর ধরে এই বিষয়টা নিয়ে নানা রকম গবেষণা করছেন। গবেষণা করতে করতে তিনি আবিষ্কার করলেন যে সাধারণ যৌন নির্যাতনকারীদের (যারা প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের ওপর যৌন নির্যাতন করে) তুলনায় শিশু যৌনাকাঙ্খীদের আইকিউ বা বুদ্ধিমত্তা গড়ে দশ পয়েন্ট কম। আরো বেরিয়ে এলো, যে শিশু যৌনাকাঙ্খীর আইকিউ এর মাত্রা যত কম, সে তত কম বয়সী শিশুদের প্রতি যৌনাকাঙ্খা অনুভব করে। এরা গড়ে সাধারণ যৌন নির্যাতনকারীদের চেয়ে খাটো হয়, পরীক্ষায়া খারাপ করে, আর এদের অনেকেই তেরো বছর বয়েসের আগে কোন না কোন ভাবে মাথায় ব্যাথা পেয়েছিল। ক্যান্টর শিশু যৌনাকাঙ্খীদের আরেকটা পরিষ্কার পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন; সাধারণ মানুষের ভেতরে বাঁহাতি বা দুহাত সমানতালে ব্যাবহার করতে পারে এমন লোকের সংখ্যা ৮-১২ শতাংশ, কিন্তু এদের মধ্যে এই হার তেত্রিশ শতাংশ। মানুষের শারীরিক-মানসিক গঠনের ফলে এধরনের যৌনবিকৃতি ঘটতে পারে, এই গবেষণায় এধরনের একটা বিষয় আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই বিষযে অন্যান্য গবেষণাগুলোও একই রকম ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এসব গবেষণার ফলাফল যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে শিশু যৌন নির্যাতনকারী, বিশেষত শিশু যৌনাকাঙ্খীদের প্রতি আমাদের মনোভাবটা ঠিক কি রকম হওয়া উচিত? খুব কঠিন প্রশ্ন, তাইনা? আমাদের মনে হতে পারে, যদি কারো মনে শিশু যৌনাকাঙ্খার ‘রোগ’ থেকেও থাকে, সে কি নিজেকে বিরত করতে পারে না এহেন অপকর্ম থকে? অনেকেই পারে, প্রায়ই নিজের সাথে কঠিন যুদ্ধ করে। আবার অনেকেই ব্যার্থ হয়। কেন? এ প্রশ্নটা দর্শনের একটা মৌলিক বিতর্কের বিষয়। বিষয়টা হল free-will বা স্বাধীন ইচ্ছার অস্তিত্ব।

মানুষের free-will বা স্বাধীন ইচ্ছা বলতে আসলে বোঝায়? সহজ ভাষায় বলতে গেলে, স্বাধীন ইচ্ছা হল নিজের ইচ্ছামত কাজ করতে পারার ক্ষমতা। দর্শনের ভাষায়, একের অধিক সম্ভাব্য পন্থা থেকে স্বেচ্ছায়, স্বাধীনভাবে একটা পন্থা বেছে নেওয়ার ক্ষমতাকে free-will বা স্বাধীন ইচ্ছা বলা হয়। সেটা খুব সামান্য বিষয় হতে পারে, যেমন আমি এই মুহূর্তে ঠিক কি ভাবব; আমি কি কাল অফিসে কোন কাজের ঝামেলা সামলাতে হবে সেটা নিয়ে ভাবব নাকি গত বছর ছুটিতে দার্জিলিংয়ে গিয়ে টাইগার হিল থেকে দেখা সূর্যোদয়ের কথা ভাবব? আবার প্রচন্ড গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত হতে পারে; যেমন আমি রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া টাকাভর্তি একটা মানিব্যাগ কি আত্বসাৎ করে ফেলব নাকি মানিব্যাগের মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করব? মোট কথা জীবনের প্রতি মুহূর্তে আমরা যা ভাবি বা করি, তা কি স্বেচ্ছায় করি? আমার কাজের দায়ভার কি সত্যিই আমার?

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এধরনের বিতর্ক অবান্তর। স্বাধীন ইচ্ছার ধারণা আমাদের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। নিজের ইচ্ছেমত কিছু করতে না পারাটা আমাদের কাছে বন্দিত্বের সামিল। ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করেই আমরা জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাই, নিজের এবং অন্যের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি। স্বাধীন ইচ্ছার অস্তিত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে আমাদের ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য আর সামাজিক রীতি-নীতির মাপকাঠি। আমরা ভাবি মানুষ তার বুদ্ধি দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে, বিচার-বিবেচনা প্রয়োগ করে স্বাধীনভাবে বেছে নিতে পারে সে কি ভাববে বা কি করবে। স্বাধীন ইচ্ছার অস্তিত্ব আমাদের জীবনে সর্বব্যাপী, আপাতদৃষ্টিতে তাই এরকমটা ভাবা খুব স্বাভাবিক।

বিষয়টা নিয়ে ধাপে ধাপে চিন্তা করা যাক। স্বাধীন চিন্তার বিপক্ষে সবচেয়ে স্পষ্ট যুক্তিটা হচ্ছে আমাদের অভিজ্ঞতা। প্রথমত, আমাদের জীবনে কি অভিজ্ঞতা হবে এর ওপর আমাদের তেমন একটা হাত নেই। যেমন, কোন দেশে, কোন শহরে, কার ঘরে একজন মানুষের জন্ম হবে সেটা কেউ নিজ থেকে ঠিক করেনা। স্রেফ ভাগ্যগুনে (বা দোষে) কেউ জন্মায় সুইজারল্যান্ডের কোন ধনীর দুলালী হয়ে, কেউ জন্মায় বাংলাদেশের কোন অজ-পাড়াগাঁয়ের চালচুলোহীন ঘরে। কেউ হয় হিন্দু, কেউবা মুসলিম। কারো ভাগ্যে জোটে সুন্দর একটা সুখি পরিবার, কেউবা বড় হয় এতিমখানায় অথবা স্রেফ রাস্তার ধারে। এই একটা বিষয়ই একজন মানুষের জীবনে রাত আর দিনের তফাৎ এনে দেয়।

আবার খুব সামান্য একটা বিষয় থেকেই অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটে যেতে পারে। রান লোলা রান (১৯৯৮) নামে একটা জার্মান সিনেমায় এই বিষয়টাই দেখানো হয়েছিলো অসামান্য শৈল্পিক দক্ষতায়। লোলা নামের একটা মেয়ের তার ছেলেবন্ধুকে বাঁচাতে বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হওয়ার ঘটনাটা সিনামাটাতে তিনবার দেখানো হয়েছে। প্রতিবার যাওয়ার পথে মেয়েটি সামান্য একটু ভিন্ন ঘটনার মুখোমুখি হয়; এই ভিন্নতাটা আপাতদৃষ্টিতে খুবই নগণ্য। কিন্তু তাতেই পালটে যায় পুরো কাহিনী, লোলা আর তার ছেলেবন্ধুর জীবন। জীবনে কাকতালীয়ভাবে আমরা ছোট-বড় নানা রকম ঘটনার সম্মুখীন হই, যেগুলো প্রায়ই আমাদের জীবনে ব্যপক প্রভাব রাখে। কেন সে ঘটনাগুলো আমাদের জীবনে ঘটে? আমরা কি সেগুলো ঘটাই?

মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা, বিশেষত শৈশবের অভিজ্ঞতার সাথে অপরাধের সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। দেখা গেছে যারা শৈশবে নানারকম বিরূপ অভিজ্ঞতার শিকার হয়, তাদের মধ্যে বড় হয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়; বিশেষত, যারা ছোট বেলায় যারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, তাদের মধ্যে। আমেরিকার বস্টন শহরের গরীব এলাকায় গবেষণা করে দেখা গেছে, কিশোর-কিশোরীদের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতার সাথে তাদের বাড়ির প্রাপ্তবয়স্কদের নেতিবাচক আচরণের একটা সুস্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। জমজ ভাইবোনদের নিয়ে করা আরেকটা গবেষণায় দেখা গেছে একজোড়া জমজ ভাইবোনের ভেতরে যে ছোটবেলায় অন্য ভাই বা বোনের তুলনায় বেশি বিরূপ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে, তাদের অপরাধপ্রবণতা ছিল প্রায় দ্বিগুন অন্য ভাই বা বোনটির তুলনায়।

মোটকথা আমাদের জীবনে কি ধরনের অভিজ্ঞতা হবে, তার বেশিরভাগই আমারা নিজে থেকে ঠিক করিনা। আর জীবনের অভিজ্ঞতার ওপরে আমাদের চিন্তা-ভাবনা, শারীরিক ও মানসিক সামর্থ এবং ফলস্রুতিতে আমদের কার্যকলাপের অনেক কিছুই নির্ভর করে, যেগুলোর ওপরে আমাদের সত্যিকারে তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।

তারপর ভাবা যাক, জিন আমাদের জীবন কতটা নিয়ন্ত্রণ করে। জিনের অস্বাভাবিকতা থেকে নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয়, এটা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। যেমন অটিজম, ডাউন সিন্ড্রম, সিস্টিক ফাইব্রোসিসের মত অনিরাময়যোগ্য সমস্যাগুলো একধরনের জিনের কারসাজি। আবার বংশগতির কারণে স্কিতসোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, বিষন্নতার মত মানসিক রোগগুলো হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। ১৯৭৭ সালের এক গবেষনায় মোনোজাইগোটিক (একটি ডিম্বানু থেকে জন্ম নেওয়া) জমজ আর ডাইজাইগোটিক(দুটি ভিন্ন ভিন্ন ডিম্বানু থেকে জন্ম নেওয়া) জমজ ভাইবোনের মধ্যে অপরাধমূলক কাজকর্মের তুলনা করা হয়। দেখা যায়, পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষেত্রে একজন মোনোজাইগোটিক জমজ ভাই বা বোনের একজন অপরাধমূলক কাজ করে থাকলে অন্যজনও অপরাধে জড়িত ছিল। ডাইজাইগোটিক জমজের ক্ষেত্রে এই হার ছিল মাত্র বারো শতাংশ। মনোজাইগোটিক জমজদের জিন একশ ভাগ মিল, ডাইজাইগোটিক জমজদের ক্ষেত্রে সেটা সত্য নয়। এখান থেকেও বোঝা যায় আমাদের জীবনে জিনের ভূমিকা কত বড়।

মানুষের জীবনে জিনের প্রভাব কতটুকু সেটা বের করতে জমজ বাচ্চাদের নিয়ে এরকম আরো অনেকগুলো পরীক্ষা হয়েছে। আরেকটি গবেষণায় আমেরিকার মিনেসোটা রাজ্যের একদল বিজ্ঞানী বিশ বছর আলাদা আলাদা পরিবারে বড় হওয়া ১৩৭ জোড়া জমজ ভাইবোনের জীবন পর্যবেক্ষণ করেন। সেখানে তারা জমজ ভাই-বোনদের ভেতরে অদ্ভুত সব সামাঞ্জস্য খুজে পান। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে জিম লুইস আর জিম স্প্রিঞ্জার নামে দুই ভাই। মাত্র ১ মাস বয়েসে আলাদা হয়ে উনচল্লিশ বছর পার করে তাদের আবার দেখা হয়। তাদের দুজনের মিলগুলো প্রায় অলৌকিক। দুজনেই দুশ্চিন্তাজনিত মাথাব্যাথায় ভুগতো, দাঁত দিয়ে সারাক্ষন নখ চিবুতো, দুজনেই একই ধরনের গাড়ি কিনেছিল, একই জায়গায় ছুটি কাটাতে গিয়েছিল, দুইজনেই পুলিশে চাকরি করত। শুধু তাই নয়। তাদের দুজনেরই প্রথম বৌয়ের নাম ছিল লিন্ডা, দ্বিতীয় বৌয়ের নাম ছিল বেটি, একজনের প্রথম সন্তানের নাম রাখা হয়েছিল জেমস এলেন লুইস আর আরকজনে প্রথম সন্তান ছিল জেমস এলেন স্প্রিঞ্জার। দুই জিম ভাইয়ের কাহিনীটা হয়তো একটু বেশিই আশ্চর্যজনক, কিন্তু গবেষণার পর গবেষণায় বারবার একই বিষয় ফুটে উঠেছে; জমজদের ভেতরে অংগভঙ্গী থেকে শুরু করে বুদ্ধিমত্তা, এমনকি ধর্মীয় মনোভাব সবকিছুর মধ্যেই ভিষন মিল। জিনের প্রভাব অগ্রাহ্য করে স্বাধীনভাবে চিন্তা করবেন? ভুলে যান।

সমকামীতাকে ইতিহাসের শুরু থেকে এক ধরনের বিকৃতি হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মে সমকামীতাকে ভয়ংকর পাপ হিসাবে দেখা হয় এখনো। আইসিসের জঙ্গিরা সমকামিতার অভিযোগে নিরীহ নারী-পুরুষদের হত্যা করছে নৃশংসভাবে। এমনকি কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানিরাও ভাবতেন সমকামিতা একটা রোগ, এর চিকিৎসা আছে। এর সবচেয়ে করুণ দৃষ্টান্ত হলেন এলান টুরিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদাণ করা কোড ভেঙে এই অসম্ভব প্রতিভাধর বিজ্ঞানী লক্ষ লক্ষ লোকের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। কোড ভাঙ্গতে গিয়ে তিনি প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামও লিখে ফেলেছিলেন। তাকে বলা হয় কম্পিউটার সায়েন্সের জনক। সেই টুরিংএরই সমকামীতার অপরাধে চাকরি গেল আর তাকে হরমোন থেরাপি নিতে হল সমকামীতার চিকিৎসা হিসেবে। মাত্র একচল্লিশ বছর বয়েসে টুরিং চলে গেলেন। সায়ানাইড বিষকৃয়ায় তার মৃত্যু হয়েছিল। আত্মহত্যা? কে জানে? কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে সমকামিতা কোন বিকৃতি নয়, কোন অসুখও নয়, এটা একধরনের জিন-নিয়ন্ত্রিত চারিত্রিক প্রবণতা। বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত পৃথিবীর ১০% প্রাণী প্রজাতির ভেতরে সমকামী প্রবণতা খুঁজে পেয়েছেন, তাহলে কি করে এটা মানুষের একার মানসিক বিকৃতি হয়? কে জানে হয়তো একদিন বেরিয়ে আসবে শিশু যৌনাকাঙ্খাও এক ধরনের জিন নিয়ন্ত্রিত প্রবণতা? কিছু কিছু বিজ্ঞজনেরা এই বিষয়টা নিয়ে এখনই গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছেন।

সবশেষে আসি স্বাধীন চিন্তার পক্ষে সবচেয়ে অকাট্য যুক্তিটি বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সহযোগে খন্ডন করতে। না হয় মেনে নিলাম যে জিনের ওপরে আমাদের কোন হাত নেই, কি অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাব তার ওপরেও তেমন একটা নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু আমাদের তো বিদ্যাবুদ্ধি আছে, চিন্তাশক্তি আছে। আমাদের অভিজ্ঞতা আর জিনগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও তাই আমরা অনেক কিছু স্বাধীনভাবে করতে পারি। সকালে উঠে আলমারি খুলে ঠিক করতে পারি আজ কোন পোষাকটা পরব। চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করতে পারি বাংলা নিয়ে পড়ব নাকি ইতিহাস। আমাদের আশেপাশে ভুরিভুরি উদাহরণ আছে কিভাবে মানুষ তাদের শারিরীক, পারিবারিক অথবা সামাজিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যায়। তাহলে স্বাধীন ইচ্ছা কেন থাকবে না?

ধ্যান বা মেডিটেশান করার চেষ্টা করে দেখেছেন কখনো। সাধারণত ধ্যান করার সময় আমরা কোন একটা বিষয়, যেমন আমাদের নিঃশ্বাস বা শরীরের অনুভূতির ওপর মনঃসংযোগ করার চেষ্টা করি। এই মুহূর্তে পড়া বন্ধ করে আপনি একটু চেষ্টা করুন তো দু’মিনিট শুধু নিঃশ্বাসের ওপর পুরো মনোযোগ ধরে রাখতে। কি পারলেন? এর মধ্যে কতবার অন্য চিন্তা খেলে গেছে মাথার ভেতর দিয়ে, আপনার প্রাণপণ চেষ্টা সত্বেও? তাহলে বুঝতে পারলেন তো, আমাদের চিন্তাও যে আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনা?

হ্যা, সকালে যে জামাটা মন চায় আপনি পরলেন, কিন্তু আপনার মন কেন কোন জামাটা চাইল, তার উত্তর কি? ধরুন লাল জামাটা আপনি বেছে নিলেন, কারণ লাল রংটা আপনার পছন্দ। কিন্তু কেন আপনার লাল রং পছন্দ? অনেকেই তো লাল রং দু’চোখে দেখতে পারেনা। সেটা আপনার ভেতর থেকে আসছে, আপনি সজ্ঞানে ঠিক করেননি লাল রংটাই আপনার পছন্দ। পছন্দ হয়ে গেছে। তেমনি ধরুন আপনি বাংলার বদলে ইতিহাস বেছে নিলেন, কারণ ইতিহাসে আপনি অনেক মজা পান, বাংলায় পান না। হয়তো আপনার স্কুলের বাংলা এবং ইতিহাসের শিক্ষক দুজনেই একই রকম ভাল ছিল। তবু আপনি ইতিহাসে মজা পেলেন। আপনি কি ঠিক করে নিয়েছিলেন যে আপনি ইতিহাসে মজা পাবেন? খুব সম্ভবত না। হ্যা, কোন কোন মানুষ প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে ওপরে উঠে আসে দৃঢ় মনোবলের জোরে। কিন্তু এই মনোবল কোথা থেকে আসে? কেন একই রকম পরিস্থিতিতে থাকা আর পাঁচজনের সে মনোবল আসেনা? তাহলে যে বিষয়গুলো পুরোপুরি আপনার ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণে আছে বলে আপতদৃষ্টিতে মনে হয়, সেগুলো কি আসলেই আপনার নিয়ন্ত্রণে আছে?

আমাদের মস্তিষ্কের শত বিলিয়ন নিউরনে প্রতিনিয়ত কত কিছু ঘটে যায় তার অতি ক্ষুদ্র একটা ভগ্নাংশ সম্পর্কে আমরা জানি। এমনকি আমরা নিজেরা কি ভাবছি বা অনুভব করছি, সেটা সম্পর্কেও আমরা প্রায়ই সচেতন থাকিনা। রোজ পণ করি ঘরের চাবিটা দরজার পাশের দেরাজে রাখব, কিন্তু রোজই ভুল হয়ে যায়। আনমনে খুশি বা রাগ হয়ে উঠি, নিজেরা খেয়াল করিনা, অন্যে দেখে বুঝে ফেলে যে। আগের একটা প্রবন্ধে আমি cognitive bias নিয়ে একটা লেখায় দেখিয়েছিলাম, মস্তিষ্ক তার কাজ কমাতে শর্টকাট খুঁজতে গিয়ে কতভাবে আমাদের স্মৃতিভ্রম ঘটায়, আগোচরে আমাদের মনে নানা রকম ভুল ধারণার বীজ বুনে দেয়, ভুল সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করে। তাহলে স্বাধীন ইচ্ছা কোথায়?

এখন কিছু আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রামাণ হাজির করা যাক। ১৯৮৩ সালে প্রথম বেঞ্জামিন লিবেট নামে একজন বিজ্ঞানী ইইজি (এক ধরনের পরীক্ষা যেখানে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করা হয়) পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান যে একজন মানুষ সচেতনভাবে শরীরের বিভিন্ন অংশ নাড়ানোর ইচ্ছা অনুভব করার আনুমানিক ৩০০ মিলিসেকেন্ড আগেই মস্তিষ্কের ভেতরে এর প্রকৃয়া শুরু হয়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে মানুষ নড়াচড়ার ব্যপারে কি সিদ্ধান্ত নেবে আর কিভাবে নড়াচড়া করবে তার ওপর।

আরেকটা গবেষণায় কিছু মানুষকে একটা ঘড়ির ডায়ালে এলোমেলোভাবে বিভিন্ন অক্ষর দেখানো হয়। তাদের বলা হয়েছিল, যখন একটা অক্ষর ভাসবে তখন সেটা মুখে বলতে আর একই সাথে তাদের সামনে রাখা দুটো বোতামের যেকোন একটা টিপ দিতে। এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এফএমআরই পরীক্ষা (আরো এক ধরনের পরীক্ষা যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের ভেতরে কি হচ্ছে সেটা পর্যবেক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করা যায়) ব্যবহার করে দেখেছেন যে, একজন লোক কোন বোতামটা টিপ দেবে সেটা সে সচেতনভাবে ঠিক করার পুরো ৭ থেকে ১০ সেকেন্ড আগেই মস্তিষ্কের ভেতরে সে সিদ্ধান্ত প্রকৃয়া শুরু হয়ে গেছে। আরকটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে মাত্র ২৫৬ টি নিউরনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করে মানুষের নাড়াচড়াস সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ৭০০ মিলিসেকেন্ড আগেই ৮০ ভাগ নিশ্চয়তার সাথে বলে দেওয় যায়।

আমরা যখন মনে করি যে আমরা সচেতনভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, সেটা আসলে আমাদের অবচেতন মনের সিদ্ধান্ত হতে পারে, ওপরের সবগুলো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাই সেদিকে ইঙ্গিত করছে।

এখানে দু’একটা বিষয় নিয়ে একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার। প্রথমত free will বা স্বাধীন চিন্তা বলতে আমরা ঠিক কি বোঝাচ্ছি। এই বিষয়ে দার্শনিকদের মধ্যে দ্বিমত আছে। কোন কোন দার্শনিক মনে করেন, আমাদের যা ইচ্ছা করে বা যা মনে আসে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষমতাই free will। আর আমরা এখানে যে free will এর কথা বলছি সেটা আরো গভীরের ব্যপার। আমরা বলছি, এই যে ইচ্ছা বা চিন্তা সেটা যদি মানুষের অভিজ্ঞতা, জিন এবং তার মস্তিষ্কের ভেতরের অবচেতন প্রকৃয়াসহ যে কোন পার্থিব কারণের প্রভাবমুক্ত হয়, তাহলেই তাকে free will বলা চলে। যদি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের বিভিন্ন কারণে আমাদের চিন্তা বা ইচ্ছার উদয় হয়, তাহলে কি করে আমরা বলি যে আমাদের ইচ্ছা স্বাধীন?

আরেকটা বিষয় হল অদৃষ্টবাদের সাথে স্বাধীন চিন্তার অনুপস্থিতির পার্থক্য। আমরা বলছি free will বা স্বাধীন চিন্তা জিনিষটা খুব সম্ভবত নেই, এই ধারণাটা দর্শনের determinism বলে একটা ধারণার সাথে সম্পৃক্ত। determinism পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত মৌলিক একটা ধারণা causality র সমতূল্য – যে কোন ঘটনা বা event এর পেছনে অবশ্যই পূর্ববর্তী একটা পার্থিব কারণ বা ঘটনা আছে। Determinism তেমনি বলে, যেকোন একটা পরিস্থিতিতে (অভিজ্ঞতা, জিন, মস্তিষ্কের ক্রিয়া-বিকৃয়ার প্রেক্ষাপটে) একটা ঘটনা শুধু একভাবেই ঘটতে পারে। এর অন্যথা হবে না। কিন্তু পরিস্থিতি পালটে গেলে, (রান লোলা রানে যেমন দেখা যায়) অন্য আরেকভাবে ঘটনাটা ঘটতে পারে। আর প্রচলিত বিশ্বাসে অদৃষ্টবাদ বা fatalism হল কপালের লিখন, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা যাই হোক না কেন, সে লিখনের কোন অন্যথা হবেনা, কারণ এটা ঈশ্বরপ্রদত্ব। আমদের ইচ্ছার উদয় হলেও, আমরা খেটে মরলেও কপালের লিখন খন্ডাতে পারবনা। Determinism সেটা বলেনা।

শুধু নিছক যুক্তি নয়, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাও যখন স্বাধীন চিন্তার বিপক্ষে প্রমাণ খাঁড়া করছে তখন সেটা সমগ্র মানবজাতির জন্য বিরাট একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের সামাজিক এবং পারিবারিক প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ স্বাধীন চিন্তার অস্তিত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ধর্ম বলে আমাদের ক্ষমতা আছে পাপ-পূন্যের বিচার করে সেই অনুযায়ী কাজ করার; তাই তার ওপর ভিত্তি করে আমাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে স্বর্গ-নরক। আইন বলে আমরা নিজেদের অন্যায় থেকে বিরত রাখতে পারি ‘স্বাধীনভাবে’, না পারলে তাই আমাদের শাস্তি হয়। পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়ে নৈতিক অবস্থান ও আচরণের ভিত্তিতে আমরা একজন মানুষ ভাল না মন্দ সে বিচার করি, কারণ আমরা ভাবি নূন্যতম নৈতিকতাবোধ মানুষমাত্রেরই থাকা উচিৎ। প্রথাবিরুদ্ধ বা ‘অসামাজিক’ কাজের বিরুদ্ধে আমরা ভুরু কুঁচকাই, যেন মানুষ ‘স্বেচ্ছায়’ প্রথা ভাঙছে। তাহলে এর সবই কি ভুল? সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, আমরা স্বাধীনভাবে ভাবতে পারি, বিচার করতে পারি, আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারি, সিদ্ধান্ত নিতে পারি ও সে অনুযায়ী কাজ করতে পারি, এ বিশ্বাসটা আমাদের আত্বপরিচয়ের একটা বড় অংশজুড়ে আছে। আমরা স্বজ্ঞানে আসলে কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা, সেটা মানুষ হিসাবে আমাদের জন্য হবে বিশাল বড় একটা ধাক্কা।

feet-in-chains

এই প্রতিটি প্রশ্নই অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা চাইলে ভবিষ্যতে একে একে সবগুলো বিষয়ে আমি কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করব। তাছাড়া আপনারা স্যাম হ্যারিসের প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা Free Will বইটা পড়ে নিতে পারেন, যেখানে এই সবগুলো প্রশ্ন নিয়ে চমৎকারভাবে আলোচনা করা হয়েছে। তবে আজ আমি যে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাই সেটা হল, স্বাধীন চিন্তা যদি সত্যিই একটা সোনার হরিণ হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের সহমর্মিতার স্বরূপটা ঠিক কিরকম হওয়া উচিৎ?

ধরুন প্রচন্ড ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটেছে। একজন লোক তার বাবা-মাকে নৃশংসভাবে খুন করে তার বড় ভাইকে ফাঁসিয়ে বাড়ি থেকে টাকাপয়সা চুরি করে পালিয়ে গেছে। সে লোকটার প্রতি আমাদের প্রচন্ড ঘৃণা হবে, তাইনা? কিন্তু যদি আপনি জানতে পারেন যে, লোকটা বহুদিন ধরে মাথায় একটা বিরাট টিউমার বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল, দিনরাত প্রচন্ড যন্ত্রণায় তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, মস্তিষ্কের যে জায়গাটা মানুষের অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করে, ঠিক সে জায়গাটাতেই টিউমারটা বাসা বেঁধেছিল, তাহলে কি লোকটাকে আমরা এতটা ঘৃণা করতে পারব? নিশ্চই না।

ঠিক সেরকম, আমরা যদি উপলব্ধি করতে পারি যে, কোন মানুষেরই সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে চিন্তা করা, কাজ করা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই, তাহলে কারো সম্পর্কে চট করে একটা নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতেও আমাদের বাধবে। তাইনা?

এই উপলব্ধি থেকে আমরা যদি আরেকটু সহমর্মী হতে পারি, তাহলে প্রথমত আমাদের ব্যক্তিগত জীবনটা আরো একটু সুন্দর হবে। আমরা সামাজিক জীব, তাই আমাদের নেতিবাচক মানসিকতার একটা বড় উৎস হচ্ছে অন্য মানুষের আচরণ, তা সে পরিবারের সদস্যই হোক, হোক আত্মীয়, বন্ধু, সহকর্মী বা আমাদের জীবনের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত যে কেউ। আমরা আমাদের সন্তানের রূঢ় আচরণে কষ্ট পাই, আত্মীয়-স্বজনের স্বার্থপরতায় তিক্ত হই, সহকর্মীর পরচর্চার অভ্যাসে বিরক্ত হই, কাজের লোক আর ড্রাইভারের ফাঁকিবাজিতে অতিষ্ট হয়ে মনে মনে তাদের গাল দেই আর আশেপাশের মানুষের নির্বুদ্ধিতা আর কূপমন্ডুকতায় প্রতিনিয়ত হতাশ হই। সজ্ঞানে হোক বা অজ্ঞানে, এধনরণের নেতিবাচক মনোভাব আমাদের জীবন ও মন বিষিয়ে তোলে। কিন্তু মানুষ কি ভাববে বা করবে তা যে সত্যিই মানুষের নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই, এটা উপলব্ধি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিতে পারে অনেকটাই। কাউকে তার বাইরের আচরণের ভিত্তিতে বিচার না করে, আমরা বোঝার চেষ্টা করতে পারি কেন সে এমন আচরণ করল। স্বাধীন চিন্তার অক্ষমতার কাছে মানুষ আদতে কতখানি অসহায়, এই কথাটা ভেবে হলেও অন্য মানুষের প্রতি আমাদের নেতিবাচক মনোভাব কিছুটা কমতে পারে। তাতে আমাদের মনের শান্তি বাড়বে বই কমবে না।

দ্বিতীয়ত, এই স্বাধীন চিন্তার অনুপস্থিতির উপলব্ধি আমাদের সমাজে পরমতসহিষ্ণুতা বাড়াতে পারে। বড় অস্থির এক সময়ে বাস করছি আমরা। শুধুমাত্র ধর্মীয় বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে একে অন্যকে ভুল বুঝি, ঘৃণা করি, অনেক সময় খুনোখুনিও করি। সমাজের জন্য ক্ষতিকর মতাদর্শকে মেনে নিতে হবে তা নয়, তবে স্রেফ ঘৃণা করার বদলে আমরা যদি নিরপেক্ষ ভাবে সে সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি, তাহলে হয়ত দেখব আমাদের অনেক ধারণাই ভুল। আবার কি কারণে একজন মানুষ উগ্র মতাদর্শের অনুসারী হয়ে ওঠে, সেটা বের করে ফেলতে পারলে, এর প্রতিকারও সম্ভব হতে পারে। কিন্তু তার আগে চাই সহমর্মিতা, অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দুনিয়াটাকে দেখার চেষ্টা করা।

অবশেষে, যারা বিভিন্ন ধরনের অন্যায় ও অপরাধমূলক কাজ করে, তাদেরকে নিয়ে আমরা কি করব? তাদের কি বিচার হবেনা? তাহলে আমাদের সমাজে শান্তি-শৃংখলা বা নিরাপত্তা বজায় থাকবে কি করে? কি করেই বা প্রতিষ্ঠা হবে ন্যয়বিচার?

কিন্তু স্যাম হ্যারিস তার Free Will বইটাতে এই বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক কেমন হওয়া উচিৎ, সে বিষয়ে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ কিছু মতামত রেখেছেন। যাদের অপরাধ প্রবণতা আছে তাদেরকে অবশ্যই এমনভাবে রাখতে হবে যাতে তারা কারো ক্ষতির কারণ হতে না পারে। কিন্তু তাদেরকে কি ঠিক ‘শাস্তি’ দেওয়া উচিৎ? মৃত্যুদন্ড? অথবা তাদের কি ঘৃনা করা উচিৎ? বরং আমরা যদি মেনে নেই যে কেউ ‘স্বেচ্ছায়’ অপরাধ করেনা, তাহলে কি কারণে মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে সেটা নিয়ে আমারা ভাবতে শুরু করতে পারব। সেই কারণগুলো সমূলে উৎপাটন করতে চেষ্টা করতে পারব। বিজ্ঞানের জগতে যেরকম উন্নতি হচ্ছে, হয়তো গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা বের করে ফেলবেন, কোন জিনের কারণে অথবা মস্তিষ্কের কোন রাসায়নিকের প্রভাবে মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে। তারা হয়তো এর সমাধানও বের করে ফেলতে পারবেন। তবে তার আগে মেনে নিতে হবে যে প্রকৃতভাবে কাউকে ঠিক ‘অপরাধী’ হিসাবে দায়ী করা যায়না।

প্রথম যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম সেটা দিয়েই শেষ করা যাক। অনেক শিশু যৌন নির্যাতনকারী প্রথম যখন বুঝতে পারে তাদের এই প্রবণতার কথা, তারা এতটাই ভীত এবং লজ্জিত হয়ে পড়ে যে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ভয় পায়। কাউকে বলার তো প্রশ্নই ওঠেনা, কারণ প্রতিটি সমাজেই শিশু যৌনাকাঙ্খাকে প্রচন্ড জঘন্য একটা বিষয় হিসবে দেখা হয়। জার্মানিতে এদের সাহায্য করার জন্য একটা সংস্থা হয়েছে। সেখানে এধরনের মানুষদের নানা রকম মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হয়, তাদের অপরাধ থেকে দূরে থাকার নানা রকম কায়দা কানুন শেখানো হয়। সেখানে গিয়ে অনেক মানুষ তাদের জীবন ফিরে পেয়েছে। যদি এধরনের লোকদের স্রেফ অপরাধী ভাবা হত, তাহলে কিন্তু এধরনের সংস্থা করার কথা কারো মাথায়ই আসত না। এই উদ্যোগের ফলে যাদের জীবন বেঁচেছে তারাই হয়তো নিষ্পাপ শিশুদের জীবন তছনছ করে ফেলত। যেদিন আমরা সবাই শিশু যৌনাকাঙ্খীদের সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখতে পারব, তাদের এই প্রবণতাটাকে তাদের একটা দূর্ভাগ্য বা রোগ হিসাবে দেখব, তখন হয়ত বেশিরভাগ শিশু যৌনাকাঙ্খীই অপরাধ করার আগেই সাহায্য চাইবে। তাতে শিশুদের জন্য এই পৃথবীটা হয়ে উঠবে আরো একটু নিরাপদ, সুন্দর।

এর সবই হয়তো সম্ভব, কিন্তু তার আগে প্রয়োজন স্বাধীন চিন্তার সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে আমাদের সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করে দেওয়া। সবার প্রতি।

Reference:
Cantor, James M., Philip E. Klassen, Robert Dickey, Bruce K. Christensen, Michael E. Kuban, Thomas Blak, Natasha S. Williams, and Ray Blanchard. “Handedness in Pedophilia and Hebephilia.” Archives of Sexual Behavior 34, no. 4 (2005): 447–459.

Case, Anne C., and Lawrence F. Katz. “The Company You Keep: The Effects of Family and Neighborhood on Disadvantaged Youths.” Working Paper. National Bureau of Economic Research, May 1991. http://www.nber.org/papers/w3705.

“Child Sexual Abuse and Subsequent Offending and Victimisation: A 45 Year Follow-up Study.” Accessed November 12, 2016. http://www.aic.gov.au/publications/current%20series/tandi/421-440/tandi440.html.
Connolly, Kate. “How Germany Treats Paedophiles before They Offend.” The Guardian, October 16, 2015, sec. Society. https://www.theguardian.com/society/2015/oct/16/how-germany-treats-paedophiles-before-they-offend.
Holden, Constance “Identical twins reared apart. Science, Vol 207(4437), Mar 1980, 1323-1328. http://dx.doi.org/10.1126/science.7188816

Currie, Janet, and Erdal Tekin. “Does Child Abuse Cause Crime?” Working Paper. National Bureau of Economic Research, April 2006. http://www.nber.org/papers/w12171.

Fereydooni, Arash. “Do Animals Exhibit Homosexuality?” Yale Scientific Magazine, March 14, 2012. http://www.yalescientific.org/2012/03/do-animals-exhibit-homosexuality/.
Harris, Sam, "Free Will", 2012

“House of Commons Committees - JUST (40-3) - Evidence - Number 048.” Accessed November 12, 2016. http://www.parl.gc.ca/HousePublications/Publication.aspx?Language=E&Mode=1&DocId=4959361&File=0.

Jefferson, Cord. “Born This Way: Sympathy and Science for Those Who Want to Have Sex with Children.” Gawker. Accessed November 12, 2016. http://gawker.com/5941037/born-this-way-sympathy-and-science-for-those-who--want-to-have-sex-with-children.

Lansford, Jennifer E., Shari Miller-Johnson, Lisa J. Berlin, Kenneth A. Dodge, John E. Bates, and Gregory S. Pettit. “Early Physical Abuse and Later Violent Delinquency: A Prospective Longitudinal Study.” Child Maltreatment 12, no. 3 (August 2007): 233–45. doi:10.1177/1077559507301841.

Lewis, Tanya, Staff Writer | August 11, and 2014 12:18pm ET. “Twins Separated at Birth Reveal Staggering Influence of Genetics.” Live Science. Accessed November 21, 2016. http://www.livescience.com/47288-twin-study-importance-of-genetics.html.

Libet, Benjamin. “Unconscious Cerebral Initiative and the Role of Conscious Will in Voluntary Action.” In Neurophysiology of Consciousness, 269–306. Contemporary Neuroscientists. Birkhäuser Boston, 1993. http://link.springer.com/chapter/10.1007/978-1-4612-0355-1_16.

“NCJRS Abstract - National Criminal Justice Reference Service.” Accessed November 12, 2016. https://www.ncjrs.gov/App/Publications/abstract.aspx?ID=47289.

Sanders, A. R., E. R. Martin, G. W. Beecham, S. Guo, K. Dawood, G. Rieger, J. A. Badner, et al. “Genome-Wide Scan Demonstrates Significant Linkage for Male Sexual Orientation.” Psychological Medicine 45, no. 7 (May 2015): 1379–88. doi:10.1017/S0033291714002451.

Widom, Cathy Spatz. “Victims of Childhood Sexual Abuse– Later Criminal Consequences,” 1995. https://www.ncjrs.gov/pdffiles/abuse.pdf.