পর্ব ১ - স্যাপিয়েন্সঃ মানবজাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস | তৃতীয় অধ্যায়
পর্ব ১ঃ বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব – তৃতীয় অধ্যায়
আদম হাওয়ার জীবনের একটি দিন
স্যাপিয়েন্সদের মন ও প্রকৃতি আর ইতিহাসের কার্যকারণ বুঝতে গেলে আমদের ঢুকতে হবে তাদের আদি পূর্বপুরুষ আরণ্যক (hunter-gatherer)দের মস্তিস্কে। ইতিহাসের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই স্যাপিয়েন্সরা অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলোর মত বন-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করে বেড়িয়েছে। মাত্র দুশ বছর আগে থেকে তারা ক্রমবর্ধমান হারে অফিস-আদালত, কল-কারখানায় খেটে খাচ্ছে আর দশ হাজার বছর আগে প্রথম কৃষিকাজের মাধ্যমে থিতু হতে শুরু করেছে। আমাদের পূর্বপুরষেরা যত সময় ধরে শিকার আর খাবার সংগ্রহ করে বেড়িয়েছে, তার তুলনায় দশ হাজার বছর কিছুই না।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান (Evolutionary Psychology) নামে মনোবিজ্ঞানের নতুন একটি শাখা এখন বেশ দ্রুত বিকশতি হচ্ছে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন আমদের বর্তমান সমাজের বহু গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক এবং মানসিক বৈশিষ্ট গড়ে উঠেছিল কৃষি বিপ্লব পূর্ববর্তী আরণ্যকদের সুদীর্ঘ যুগে। তারা বলেন যে, সে সুদুর অতীতের অবচেতন স্মৃতি এখনো আমাদের মন ও মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে অনেকটাই। আমাদের খাদ্যাভ্যাস, ভেতরকার দ্বন্দ্ব, নারী পুরুষের সম্পর্ক ইত্যাদি কেমন হবে তা নির্ভর করে আমাদের আরণ্যক মন কিভাবে বিক্রিয়া করে এ যুগের টেলিফোন, কম্পিউটার, উড়োজাহাজের অবিশ্বাস্য গতি আর মহানগরের কোলাহলময় যান্ত্রিকতা, ইত্যাদির সাথে বা এক কথায় শিল্পয়ায়ন-পরবর্তী আধুনিক যুগের সাথে। পূর্ববর্তী যে কোন যুগের তুলনায় আধুনিক যুগ আমাদের দিয়েছে অনেক বেশি পার্থিব সম্পদ আর দীর্ঘতর জীবন কিন্তু একই সাথে আমাদের করেছে নির্বিকার, হতাসাগ্রস্থ এবং সদা উৎকণ্ঠ। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন যে এসব বিষয় বুঝতে হলে আমাদের ডুব দিতে হবে আরণ্যকদের মনে, যে মন আমাদের অবচেতনে বসে আজোও কলকাঠি নাড়ছে।
উচ্চ-ক্যালরিযুক্ত খাবার যেমন আলু, মিষ্টি, ভাজাপোড়ার খারাপ দিকগুলো ভালভাবে জানা সত্বেও আমরা কেন এসব খাবার পাগলের মত খাই? উন্নত বিশ্বে স্থুলতা একটা মহামারীর আকার ধারণ করেছে, আমাদের মত গরীব দেশগুলোতেও ইদানিং কোমরের ঘের ক্রমাগত বাড়ছে। আমাদের কি নিজেদের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই? মিষ্টি আর তৈলাক্ত খাবার দেখলে কেন আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি তার কারণ বুঝতে হলে আমাদের আরণ্যকদের খাদ্যাভ্যাসের দিকে নজর দিতে হবে। বনে বাঁদাড়ে খাবার জিনিষটারই ঘাটতি থাকত সবসময়, মিষ্টি আর তৈলাক্ত খাবারতো ছিল আরো দুষ্প্রাপ্য। তিরিশ হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ আরণ্যকদের একমাত্র মিষ্টি খাবারের উৎস ছিল পাকা ফল। খাবারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে কোন আদিম মানবসন্তান যদি ভাগ্যক্রমে একটা ফলন্ত বৃক্ষ খুঁজে পেত, তার প্রথম কাজ হত তৎক্ষণাৎ ইচ্ছেমত ফল খেয়ে পেটটি ভরে ফেলা। কারণ কতটুকুই বা সে বয়ে নিতে পারত? আর পারলেও ফল তো বেশিদিন থাকতোনা, দ্রুত পঁচে যেত। পরে ফিরে আসলে সে গাছে ফল থাকার কোন নিশ্চয়তা থাকত না, বাঁদর বেবুন নিশ্চই খেয়ে সাফ করে ফেলত। তাই উচ্চ-ক্যালরিযুক্ত খাবার হাপুস-হুপুস করে খাওয়ার প্রবণতাটা আমাদের জিনে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। এখন আমরা ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকি, আমারদের ফ্রিজ ভর্তি থাকে খাবারে। কিন্তু আমাদের জিন এখনো মনে করে আমরা বনে-বাদাড়ে বাস করি, যেখানে উচ্চ-ক্যালরিযুক্ত খাবারের বড়ই অভাব। তাই ফ্রিজ খুলে আইসক্রিমের বাক্স হাতে পেলে আমরা প্রায় স্বয়ংকৃয়ভাবে পুরোটা সাবাড় করে ফেলি, তারপর এক গ্লাস কোক খেয়ে বেশি আইসক্রিম খাওয়ার ফলে পেটে যে অস্বস্তি হয় সেটা কমাই।
‘পেটুক জিন’ তত্বের একটা মোটামুটি শক্ত ভিত তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু এরকম আরো অনেক তত্ব আছে, যেগুলো এখনো বিতর্কের বিষোয়বস্তু। যেমন অনেক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে আদিম মানুষেরা একগামী সম্পর্কে বিশ্বাস করতো না। তারা দলবদ্ধভাবে থাকত। আদিম নারীদের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল যে কোন পুরুষ সঙ্গী গ্রহণ করার। ফলে বাচ্চাদের পিতৃত্ব সম্পর্কে কেউ নিশ্চিতভাবে জানতো না, তারা এটা নিয়ে মাথাও ঘামাতো না। নারী পুরুষ নির্বিশেষে দলের সবাই বাচ্চাগুলোকে নিজের বাচ্চার মতই মানুষ করতো।
এটা কিন্তু মানুষের একার ক্ষেত্রে প্রজোয্য নয়। প্রাণীদের মধ্যে এই প্রবণতা প্রায় সর্বজনবিদিত, বিশেষত আমাদের স্বজন বেবুন আর শিম্পাঞ্জিদের ভেতরে। এমনকি আজো কিছু স্যাপিয়েন্স সমাজ, যেমন বারি ইন্ডিয়ানদের ভেতরে এরকম সঙ্ঘবদ্ধ পিতৃত্বের রীতি বজায় আছে। এ ধরণের সমাজের লোকেরা ধারণা করে যে মাত্র একজন পুরুষের বীর্য থেকে সন্তানের জন্ম হয় না, বহু পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারীর জঠরে সন্তান বেড়ো ওঠে। এ সমাজের একজন ভাল মা, বিশেষত সন্তানসম্ভাবা অবস্থায়, শুধু একজন ভাল শিকারীর সংগেই শারিরীকভাবে মিলিত হবেন না, ভাল গল্প বলিয়ে, বলিষ্ঠ যোদ্ধা আর দায়িত্ববান প্রেমিকের সঙ্গও উপোভোগ করবেন, যাতে গর্ভের সন্তান সব ভালো গুণগুলো নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়! শুনতে হাস্যকর শোনাচ্ছে? আমাদের মনে রাখতে হবে যে আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণেই আমরা আজ নিশ্চিতভাবে জানি যে একটি শুক্রাণু আর একটি ডিম্বানুর মিলনেই নারীর গর্ভে সন্তান আসে, এর আগে পর্যন্ত এব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছিলনা।
যারা এধরনের প্রাচীন সমাজের তত্ব বিশ্বাস করেন, তাদের ধারণা আজকের যুগের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ছড়াছড়ি, বিবাহবিচ্ছেদের উচ্চ হার আর প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের নানাবিধ মানসিক জটিলতার মূলে আছে আমাদের বহুগামী স্বভাবকে সামাজিক বিধি নিষেধের লাগাম পরানোর চেষ্টা আর পরিবারের আকার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাওয়া।
অনেক বিজ্ঞানী আবার এই তত্ত্বের ঘোর বিরোধিতা করেন। তারা বলেন, একগামীতা এবং ছোট পরিবার মানব সমাজের একটা মৌলিক বৈশিষ্ট। যদিও আমাদের পূর্বপুরষ আরণ্যকরা সাম্যবাদী এবং ঘনিষ্ট দলভিত্তিক সমাজে বসবাস করত, এই ধারার বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সেসব দলগুলো আবার ছোট ছোট পরিবারে বিভক্ত ছিল। তাদের কথা হচ্ছে, সেকারনেই আজকে পৃথিবীর সব জায়গায় একগামী সম্পর্কের জয়জয়কার, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা সম্পর্কে এত বেশি অধিকারবোধ আর পিতা পুত্রের পরম্পরার এত গুরুত্ব বিশ্বজুড়ে।
এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে হলে আর নরনারীর সম্পর্কের স্বরূপ বুঝতে হলে আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনধারণের পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হবে। যেমন, সত্তুর হাজার বছর আগে বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের শুরু থেকে বারো হাজার বছর আগে কৃষি বিপ্লবের মধ্যবর্তী সময়ে কিভাবে তারা জীবন যাপন করতো?
দূর্ভাগ্যবসত, আমাদের আরণ্যক পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত করে কিছু বলা খুব কঠিন। আরণ্যক সমাজের বহুগামীতা-অনুমোদোক যৌথ পরিবার কাঠামো বনাম একগামীতা-নির্ভর একক পরিবারের বিতর্কের ভিত্তি খুবই দুর্বল। এবিষয়ে আমাদের কাছে কোন লিখিত ইতিহাস নেই। আর নৃতাত্বিক প্রমাণ বলতে আছে হাড়ের ফসিল আর ফেলে যাওয়া পাথরের তৈরি ব্যবহার্য। পচনশীল উপাদান যেমন বাঁশ, কাঠ বা চামড়ার জিনিষপত্রের নমুনা খুবই দুষ্প্রাপ্য।তাই নৃতাত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা যদি বলি আমাদের আরণ্যক পূর্বপুরুষেরা পাথর যুগে বাস করতো, সেটা একদমই ঠিক হবে না। পাথর যুগকে আসলে বলা উচিত কাঠের যুগ। বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব-পরবর্তী যুগের মানুষের বেশিরভাগ ব্যবহার্য জিনিষপত্র কাঠের তৈরি হত, কাজেই তার আগেও সেটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
তাই নৃতাত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে আরণ্যকদের জীবন কেমন ছিল অনুমান করতে চাওয়াটা ভুল। আরন্যক এবং তাদের কৃষিনির্ভর এবং অবশ্যই শিল্পনির্ভর স্যাপিয়েন্স সমাজের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্যটা হল আরণ্যকদের জীবনে মনুষ্যসৃষ্ট ব্যবহার্য সামগ্রীর কোন রকম বাহুল্য ছিল না, তাদের জীবন ছিল মূলত প্রকৃতি-নির্ভর। একজন আধুনিক স্যাপিয়েন্স, বিশেষত যে পশ্চিমা বিশ্ব বসবাস করে, এক জীবনে গাড়ি-বাড়ি থেকে শুরু করে টিশু পেপার টুথব্রাস পর্যন্ত প্রায় কোটি খানেক মনুষ্যশৃষ্ট জিনিষ ব্যবহার করে। বর্তমানে এমন কোন কাজ, আচরন এমনকি আবেগ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে যেখানে জিনিষের কোন ভূমিকা নেই। আমাদের খাদ্যাভ্যাসের কথাই চিন্তা করুন। এই এক ক্ষেত্রেই মানুষের তৈরি যে পরিমাণ জিনিষের ব্যবহার হয়, ভাবলে মাথা ঘুরে যায় – হাড়ি-পাতিল, বাসন-গেলাস, ছুড়ি-চামচ থেকে শুরু করে জিএমও চাল, গম শব্জী আর পাহাড়প্রতিম খাদ্যবাহী সমুদ্রগামী জাহাজ পর্যন্ত। আমাদের খেলার জগতে আছে কাগজের তাস থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক স্টেডিয়াম। আমাদের প্রেমের সম্পর্কে আছে ভাল জামাকাপড়, আংটি, চাইনিজ রেস্তোরাঁ, বিছানা, ঘর, বিয়ের আয়োজোন, আর কত কি। আমাদের ধর্মীয় জীবন জুড়ে আছে মন্দির, মসজিদ গির্জা, দেবীমূর্তি, ধূপ-ধূনো, টুপি জায়নামাজ, তসবিহ, প্রদীপ, মোম আর ক্রিসমাস ট্রি।
আমাদের জীবনে কত জিনিষ আছে সেটা আমরা টের পাই বাড়ি শুধু বদলের সময়। আমাদের পূর্বপুরুষ আরণ্যকেরা তাদের যা কিছু সম্বল তাই কাঁধে করে প্রতি মাসে, কখনো কখনো প্রতি সপ্তাহে, চাইকি প্রতিদিন ‘বাড়ি’ বদল করত। তখন তো জিনিষ বয়ে নিয়ে যাওয়ার গাড়িও ছিল না, পোষ মানানো ঘোড়া বা গাধাও ছিলনা। তাই যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হত তাদের। কাজেই তাদের জীবনের বেশিরভাগ জুড়ে জিনিষের তেমন ভূমিকা ছিলনা, এতটুকু আমরা ধরে নিতেই পারি। আজ থেকে এক লক্ষ বছর পরের কোন নৃতাত্বিক খুব সহজেই আজকের দিনের জীবনযাত্রার নানা রকম বাস্তব প্রমাণ পেয়ে যাবেন আর এর ওপর ভিত্তি করে আমাদের বর্তমান সমাজ কেমন, সে বিষয়ে মোটামুটি সঠিক ধারণা পাবেন। কিন্তু আরণ্যকদের সম্পর্কে জানতে আমাদের এধরণের প্রমাণ খুবই বিরল, তাই তাদের জীবনযাত্রা, বিশ্বাস, রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান মূলত আমাদের কাছে রহস্য।
এর একটা সমাধান হচ্ছে বর্তমান আরণ্যক নৃগোষ্ঠীগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। তবে আধুনিক আরণ্যকদের জীবনযাত্রার ওপর ভিত্তি করে আদিম আরণ্যকদের বিষয়ে একশ ভাগ নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
প্রথমত, আধুনিক সব আরণ্যক নৃগোষ্ঠীই কোন না কোন ভাবে কৃষি, শিল্প ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সংস্পর্শে এসেছে। কাজেই তাদের ব্যপারে যেটা সত্য, আদিম আরণ্যকদের ব্যপারে সেটা সত্য নাও হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বর্তমান আরণ্যক নৃগোষ্ঠীগুলো সাধারাণত মানুষের বসবাসের অনুপোযোগী, কৃষিকাজের অনুপযুক্ত দুর্গম এলাকাগুলোতে বাস করে। তাই কঠিন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো উষঢ় কালাহারির বর্তমান বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার সাথে উর্বর নদীতীরে বসবাসকারী আদিম আরণ্যকদের জীবনযাত্রার তুলনা করাটা সমিচীন হবে না। বিশেষত কালাহারির মত কঠিন পরিবেশে জনসংখ্যার ঘনত্বের তুলনায় সে নদীতীরবর্তী লোকালয়ের জনসংখ্যার ঘনত্ব এমনকি সে আমলেও অনেক বেশি ছিল। স্যাপিনেস দলের আকার ও সংগঠন এবং দলের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রকৃতির ওপর এই ঘনত্বের প্রভাব অতি গভীর।
তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বিষয় হল, আরণ্যক সমাজগুলোর একটা মূল বৈশিষ্ট হচ্ছে এগুলোর স্বাতন্ত্র। শুধু যে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গেলে এই পার্থক্য চোখে পড়বে তা নয়, একই এলাকার ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন আরণ্যক দলের মধ্যে থাকতে পারে ব্যপক পার্থক্য। ইওরোপিয়ান ঔপনিবেশকরা অস্ট্রেলিয়ায় পদার্পন করে সেখানকার আরণ্যক আদিবাসী সমাজেগুলোর ভেতরে অনেক পার্থক্য দেখতে পান। ব্রিটিশদের অস্ট্রেলিয়া জয়ের আগে সেখানকার মাত্র তিন থেকে সাত লক্ষ আদিবাসী দুইশ’ থেকে ছয়শো’ উপজাতিতে বিভক্ত ছিল, প্রতিটি উপজাতি আবার অনেকগুলো ছোট ছোট দলে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি উপজাতির ছিল নিজস্ব ভাষা, ধর্ম এবং আচার।দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান এডেলেইডের বিভিন্ন আদিম নৃতাত্বিক জনগোষ্টী পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বিশ্বাস করত আর কে কোন এলাকা থেকে এসেছে তার ভিত্তিতে নির্ধারণ হত ব্যক্তির জাতিগত পরিচয়। অন্যদিকে উত্তর অস্ট্রেলিয়ার অনেক উপজাতির ভেতরে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, আর কে কোন উপজাতির লোক সেটা নির্ভর করত সে কোন দেবতা মানে তার ওপর ওপর, এলাকার ওপর নয়।
তাহলে এটা মোটামুটি ধরে নেওয়া যায় যে আদিম আরণ্যকদের জাতিগত এবং সংস্কৃতির বৈচিত্র ছিল ব্যপক। কৃষি বিপ্লবের আগে পৃথিবীর পঞ্চাশ থেকে সত্তুর লক্ষের মত স্যাপিয়েন্স জনগোষ্ঠী হাজার হাজার উপজাতিতে বিভক্ত ছিল। তাদের ছিল ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি। এ দুটো বিষয় তো আসলে বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের মূল ভিত্তি ছিল। নিজস্ব ভাষার কল্যাণে একই এলাকায় বাস করেও দুটি ভিন্ন উপজাতির লোকেরা নিজস্ব কাল্পনিক বাস্তবতা রচনা করেছে। তার ফলে গড়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস, রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠান। যেমন, কেম্ব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালইয়ের দুরত্ব খুব বেশি নয়। কিন্তু এই দুই অঞ্চলের আদিম নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে হয়ত অনেক পার্থক্য ছিল। হয়ত একটা গোষ্ঠী ছিল শান্তিপ্রিয় আরকেটা ছিল যুদ্ধংদেহী। এক গোষ্ঠিতে প্রচলিত ছিল যৌথ পরিবার, আরেকটাতে একক পরিবার। কেম্ব্রিজের অধিবাসীরা হয়ত কাঠের তৈরি দেবতার পূজা দিত, আর অক্সফোর্ডের অধিবাসীরা নেচে নেচে সূর্যদেবের আরাধনা করতো। এক গোষ্ঠী হয়ত পূর্বজন্মে বিশ্বাস করতো, আরেক গোষ্ঠী বিশ্বাস করতো এক জন্মে। হয়ত এক গোষ্ঠী সমকামিতা অনুমোদন করত, অন্য গোষ্ঠীতে সেটা হয়ত ছিল অপরাধ।
মোট কথা, আধুনিক আরণ্যক নৃগোষ্ঠীগুলো নিয়ে গবেষণা করে আমরা কোনো কোনো প্রাচীন আরণ্যক সমাজ সম্পর্কে ধারণা পাব, তবে সব নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে সাম্যক ধারণা লাভ করা মোটামুটি অসম্ভব, তার বেশিরভাগটাই হারিয়ে গেছে সময়ের অন্তরালে।
আজকাল অনেকেই একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে। স্যাপিয়েন্সদের স্বাভাবিক অর্থাৎ প্রাকৃতিক জীবন যাপন পদ্ধিতি কি রকম হওয়া উচিত। তবে এ আলোচনায় একটা বিষয় মনে রাখা উচিত। বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের শুরু থেকে মানুষের নির্দিষ্ট একটি স্বাভাবিক জীবন যাপন পদ্ধতি বলে কিছু ছিলনা। ছিল হাজারো রকমের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা।
প্রকৃত সমৃদ্ধশালী সমাজ
তাহলে কৃষি-বিপ্লব পূর্ববর্তী স্যাপিয়েন্স সমাজ সম্পর্কে আমরা সাধারণভাবে কি কিছুই বলতে পারিনা? এরা বেশিরভাগই কয়েক ডজন বা বড়জোর কয়েকশ’ লোকের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে থাকত আর এরা প্রায় সবাই ছিল মানুষ, এটুকুই নির্দিধায় বলা যায়। প্রায় সবাই মানুষ ছিল, এই কথাটা আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হতে পারে। তবে একটু ভেবে দেখলেই একথার মর্ম বোঝা যাবে। কৃষি এবং শিল্প ভিত্তিক সমাজের বেশিরভাগ সদস্যই কিন্তু গৃহপালিত পশু! এটা ঠিক যে গৃহপালিত পশুদের সমাজে আমরা কোন মর্যাদা দেই না। তবুও তারা সমাজের সদস্যই তো! আধুনিক কিউই (নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী) সমাজে স্যাপিয়েন্স সদস্য সংখ্য পয়তাল্লিশ লাখের মত, আর সেখানে শুধু ভেড়াই আছে পাঁচ কোটি!
আদিম আরণ্যক সমাজের একমাত্র গৃহপালিত পশু ছিল কুকুর। কুকুর আসলে ছিল স্যাপিয়েন্সদের প্রথম গৃহপালিত পশু। স্যাপিয়েন্সরা কৃষি বিপ্লবের বহু আগেই কুকুর পোষ মানিয়েছিল। ঠিক কবে থেকে কুকুর পোষ মেনেছিল এবিষয়ে বিশষজ্ঞদের ভেতরে মতপার্থক্য আছে। তবে অন্তত পনেরো হাজার বছর আগেও কুকুর মানুষের সঙ্গী ছিল সেটা একেবারে নিশ্চিত। এরও হাজার হাজার বছর আগেই নিশ্চই মানুষ কুকুর পোষ মানাতে শুরু করেছিল।
স্যাপিয়েন্সরা কুকুরের সাহায্যে শিকার করত, যুদ্ধও করতো কুকুরগুলোর সাহায্যে। আবার বন্য পশু বা অন্য গোত্রের লোকের অনধিকার প্রবেশ সম্পর্কে আগাম সংকেত দিত কুকুর। সময়ের সাথে স্যাপিয়েন্স এবং কুকুর একে অপরের সাথে ভাব বিনিময় করতে শিখল আর মানুষের সাথে কুকুরের সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হল।
মানুষ কুকুরের বিবর্তনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিল। যেসব কুকুর তাদের স্যাপিয়েন্স সঙ্গীর আবেগ অনুভূতি বুঝে সে অনুযায়ী চলত, তারা পেত ভাল খাবার আর যত্ন। ফলে এধরণের কুকুরের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা হত বেশি। আর কুকুরও কালক্রমে শিখে নিলো কি করে স্যাপিয়েন্সদের কাছ থেকে ভালবাসা আদায় করে নিতে হয়। এভাবে কালের বিবর্তনে স্যাপিয়েন্স ও কুকুর হয়ে উঠলো একে অন্যের আদর্শ সঙ্গী। পনেরো হাজার বছরে স্যাপিয়েন্সদের সাথে কুকুরের সম্পর্ক যতটা গভীর হয়ে উঠলো, অতটা গভীরতা স্যাপিন্সদের সাথে অন্য কোন প্রাণীর সম্পর্কে কখন আসেনি। স্যাপিয়েন্স পোষা কুকুরকে অন্য সাপিয়েন্স সংগীর মতই ভালবাসে। অনেক সময় মৃত কুকুরের মানুষের মতই সৎকার করা হয়!
আরণ্যক গোত্রের সবাই সবাইকে খুব ভালভাবে চিনত। সারাজীবন তারা পরিবার পরিজন পরিবেষ্টিত হয়ে থাকত। সেখানে একা একা লাগার কোন অবকাশ ছিলনা আর ব্যক্তিগত সময় বলতে কিছু ছিল না। প্রতিবেশি গোত্রগুলো সম্পদের অধিকার নিয়ে নিজেদের সাথে লড়াই করতো নিশ্চই, তবে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বসুলভ ভাব বিনিময়ও হতো। তাদের মধ্যে সদস্য বিনিময় হত, তারা একসাথে শিকার করতো, দুষ্প্রাপ্য পণ্য বিনময় করত, রাজনৈতিক কোয়ালিশান গড়ে তুলত, সম্মিলিতভাবে ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করতো। এধরণের সহোযোগিতাই তো আসলে স্যাপিয়েন্সদের প্রধাণ বৈশিষ্ট ছিল। আগেই বলা হয়েছে, অন্য যে কোন প্রাণীর ওপরে স্যাপিয়েন্সের আধিপত্য বিস্তারের এটা একটা মুল কারণ। মাঝে মাঝে দুটো পাশাপাশি গোত্রের সম্পর্ক এত গভীর হত যে দুই গোত্র মিলে একটা উপজাতি হয়ে যেত। ধীরে ধীরে তাদের ভাষা, পুরাণ, আচার, রীতিনীতি, বিধান ইত্যাদি এক হয়ে যেত।
তবে আদিম আরণ্যকদের জীবনে গোত্রের সাথে গোত্রের এই সম্পর্কেটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। যদিও একই উপজাতির অন্য গোত্রের সাথে মিলে স্যপিয়েন্সরা মাঝে মাঝে শিকার করতো, যুদ্ধ করতো, উৎসব করতো, কিন্তু তাদের বেশিরভাগ সময়ই কাটত নিজেদের গোত্রের ভেতরে। বাণিজ্য সীমাবদ্ধ ছিল সৌখিন জিনিষপত্রের মধ্যে, যেমন শঙ্খ, রঙ, রঙ্গিন পাথর ইত্যাদি। তারা নিজেদের ভেতরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিনিময় করত, অথবা তাদের জীবন আমদানীকৃত পণ্যের ওপর নির্ভর করত, এরকম কোন নজির নেই। রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও সেটা খুব একটা শক্ত ছিলনা। মাঝে মাঝে হয়ত যৌথ সভা হতো, তবে কোন স্থায়ী রাজনৈতিক কাঠামো ছিল না। সে সময়কার সাধারণ একজন লোক হয়ত মাসের পর মাস গোত্রের বাইরের কারো সাথে কথাই বলত না। সারা জীবনে সে বড়জোর কয়েকশ’ লোকের দেখা পেতো। সারা বিশ্বে স্যাপিয়েন্স জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল খুবই কম।কৃষি বিপ্লবের আগে সারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিল কায়রো শহরের বর্তমান জনসংখ্যার চেয়ে কম।

তাদের ছিল যাযাবর জীবন। তারা খাদ্যের সন্ধানে এখান থেকে সেখানে ঘুরে বেড়াতো। তাদের যাত্রা নির্ভর করতো ঋতু পরিবর্তন, বন্যপ্রাণির মাইগ্রেশানের গতিপথ আর উদ্ভিজ্জ ফলনের সময়ের ওপর। সাধারণত তারা একই এলাকার ভেতরেই ঘোরাফেরা করত। গন্ডিটা চল্লিশ পঞ্চাশ থেকে দুই একশ’ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হতো।
কখনো কখনো কোন কোন গোত্র নিজেদের পরিচিত সীমানার বাইরে পা বাড়াত বিভিন্ন কারনে – যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জনসংখ্যার চাপ অথবা কোন দুরদর্শী নেতার প্রনোদোণায়। এভাবেই ধীরে ধীরে স্যাপিয়েন্সরা আফ্রিকা থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ধরুন একটা আরণ্যক গোত্র যদি প্রতি চল্লিশ বছরে দুভাগ হয়ে যার আর এক ভাগ পুরোনো গোত্রের অবস্থান থেকে একশ’ কিলোমিটার পূবে সরে আসে, আর এভাবেই যদি চলতে থাকে, তাহলে পুর্ব আফ্রিকা থেকে চিনে পৌছুতে স্যাপিয়েন্সদের মাত্র দশ হাজার বছর লাগবে।
দূর্লভ কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষত যেসব জায়গায় খাদ্যের ব্যপক প্রাচুর্য ছিল, সেসব যায়গায় আরণ্যক দল দীর্ঘমেয়াদী এমনকি স্থায়ী বসত গেড়েছিল। যখন খাবার সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি, যেমন শুকিয়ে বা ঠান্ডায় জমিয়ে রাখা, ইত্যাদি আবিষ্কার হল, তখন দীর্ঘমেয়াদীভাবে কোথাও থাকাটা কিছুটা সহজ হল। বিশেষত সাগর আর নদীতে যেহেতু সারাবছরই মাছ পাওয়া যেত, সাগর পারে আর নদীতীরে তাই স্থায়ী জেলেপাড়া গড়ে উঠেছিল কৃষিবিপ্লবের বহু আগেই। মানুষের প্রথম স্থায়ী বসতি তাই ছিল জেলেপাড়া। ধারণা করা হয়, ইন্দোনেশিয়ায়র উপকূলে ৪৫,০০০ বছর আগে থেকে এরকম জেলেপাড়া গড়ে উঠত শুরু করে। হয়ত সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল স্যাপিয়েন্সদের প্রথম সমুদ্র অভিযান অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে।
যাই হোক বেশিরভাগ আরণ্যক গোত্রের খাদ্যতালিকা ছিল বিচিত্র ও বিস্তৃত। তারা মোটামুটি যা পাওয়া যায়, তাই খেত। তারা পোকামাকড় খুঁটে খেত, গাছের ফল পেড়ে খেত, মাটি খুড়ে পুষ্টিকর মূল খুঁজে নিত, ফাঁদ পেতে খরগোশ ধরতো আর শিকার করত যখন যা পেত, হরিণ, বাইসন বা ম্যামথ। যদিও আরণ্যকদের মূল পরিচয় শিকারী হিসাবে, খাবার কুড়িয়ে বেড়ানো ছিল তাদের মূল কাজ। কুড়ানো খাবার যে শুধু তাদের ক্যালোরির মূল উৎস ছিল তা নয়, কুড়িয়ে আনা চকমকি পাথর, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি স্যাপিয়েন্সদের নানা রকম কাজে লাগত।
স্যাপিয়েন্সরা যে শুধু খাবার বা প্রয়োজনীয় জিনিষ কুড়াতে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতো, তা নয়। ঘুরে ঘুরে তারা নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জনও করত। বেঁচে থাকার জন্য তাদের সীমানার ভেতরে যা কিছু আছে সেসব সম্পর্কে খুব ভাল জ্ঞান থাকা খুব প্রয়োজন ছিল। সবচেয়ে অল্প পরিশ্রমে যাতে রোজকার খাবার জোগাড় করা যায়, সে জন্যে কোথায় কখন কোন ফলমূল জন্মায়, কোথায় গেলে পাওয়া যাবে হরিণের পাল, এসব জানাটা তাদের জন্য ছিল খুব জরুরী। তাদের জানতে হতো কোন খাবারটা পুষ্টিকর, কোনটা বিষাক্ত আর কোনটার আছে অষুধী গুনাগুন। ঋতু পরিবর্তনের ফলাফল কি, ঝড় বা খরার পূর্বাভাষ কি, এগুলো তথ্য ছিল তাদের বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় তথ্য। তাদের সীমানার প্রতিটি পানির উৎস, প্রতিটি বাদাম গাছ, প্রতিটি ভালুকের গুহা, প্রতিটি চকমকি পাথরের খনি তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতো। আরণ্যক গোত্রের প্রতিটি সদস্যকে জানতে হত কি করে পাথর চেঁছে ছুঁড়ি বানাতে হয়, খরগোশের ফাঁদ পাততে হয়, হিমবাহ, সাপের কামড় আর ক্ষুধার্ত সিংহের মোকাবিলা করতে হয়। এ ধরনের প্রতিটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে তাদের বছরের পর বছর গুরুর সান্নিধ্যে থেকে শিখতে এবং অভ্যাস করতে হত। যে কোন একজন আদিম আরণ্যক কিছুক্ষনের মধেই একখন্ড ফ্লিণ্ট পাথরকে ধনুকের ফলায় পরিনত করতে পারত। আমরা এটা চেষ্টা করতে গেলে হাস্যকরভাবে বিফল হব। আমাদের সেরকম শক্তিশালী পেশী বা বা আঙ্গুলের নৈপুন্য নেই।
অন্য কথায় বলতে গেলে, বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব পরবর্তী আদিম আরণ্যকদের আশেপাশের জগত সম্পর্কে জ্ঞান ছিল অনেক বিস্তৃত, গভীর এবং বৈচিত্রময়, যার কানাকড়িও আমাদের, মানে আধুনিক স্যাপিয়েন্সদের নেই। আধুনিক শহুরে সমাজের কোন বাসিন্দাকে খুব একটা প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়না, অত্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে, তাই তেমন কিছু জানতেও হয়না। একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী, বা একজন ইতিহাসের শিক্ষক বা একজন কারখানার শ্রমিক হিসাবে আপনাকে কি কি জানতে হয়? আপনার কাজের নির্দিষ্ট বিষয়গুলো ভালোভাবে জানলেই মোটামুটি চলে যায়। জীবনধারণের জন্য আর যা যা প্রয়োজোন, তার জন্য আপনি অন্ধের মত নির্ভর করবেন অন্য অনেকের ওপর, যাদের আবার আমাদেরই মত একটা বা দুটো নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা আছে। আধুনিক স্যাপিয়েন্স সমাজ সম্মিলিতভাবে হয়ত আদিম আরণ্যকদের চেয়ে হাজার কোটি গুণ জ্ঞান ও দক্ষতার মালিক, কিন্তু বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব পরবর্তী একজন সাধারণ আরণ্যক স্যাপিয়েন্স ছিল মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে জ্ঞানী ও দক্ষ ব্যাক্তি।
স্যাপিয়েন্স মস্তিষ্কের আকৃতি আরণ্যক যুগের অবসানের পর থেকে কিছুটা ছোট হয়ে গিয়েছে, এ ধরনের ইঙ্গিতবাহী কিছু প্রমাণও পাওয়া যায়। সে যুগে টিকে থাকর জন্য আরণ্যকদের অবিশ্বাস্য রকমের মানসিক উৎকর্ষের প্রয়োজন হতো। কৃষি ও পরবর্তীতে শিল্পযুগে স্যাপিয়েন্সরা বেঁচে থাকার জন্য ক্রমবর্ধমানহারে অন্যের জ্ঞান ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করা শুরু করল। তখন ‘অযোগ্য’ লোকেদেরও সুযোগ সৃষ্টি হতে থাকলো তাদের কোন-কাজ-না-জানা জিন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সফল ভাবে এগিয়ে নেওয়ার। কারখানার গতবাঁধা কাজ করা বা দারোয়ান হিসাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তেমন কোন জ্ঞান বা দক্ষতা প্রয়োজন নেই। তবে এতে টিকে থাকা বা বংশবিস্তার বাধাগ্রস্থ হয়না।কিন্তু একজন অদক্ষ্য আরণ্যকের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা সাধারণত বেশ কম হত, অন্যদিকে সুস্থ, সবল, দক্ষ জিনের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলার সম্ভাবনা হত বেশি।
আরণ্যকরা যে শুধু তাদের আশেপাশের জীব ও জড় জগত সম্পর্কেই গভীর জ্ঞানার্জন করেছিল তা নয়, নিজেদের দেহ সম্পর্কেও তাদের গভীর জ্ঞান ছিল। আর তারা অতি সুক্ষভাবে পঞ্চেন্দ্রীয়ের ব্যবহার করতে পারত। সামান্যতম শব্দেও তাদের কান খাঁড়া হয়ে যেত, এটা কি ঘাসের ওপরে সাপের চলাচলের আভাষ? তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফল, পাখির বাসা বা মৌচাকের খোঁজ করতো। তারা নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারত। যেহেতু খাবার ছিল অনিশ্চিত একটা বিষয়, তারা জানতো কি করে সবচেয়ে কম শক্তি খরচ করে বসতে, দাঁড়াতে, হাঁটতে বা দৌড়াতে হয়। সর্বক্ষণ দেহের নানারকম ব্যবহারের ফলে তারা একেকজন হয়ে উঠত ম্যারাথনের দৌড়বিদদের মতই শক্ত সমর্থ। আমরা বছরের পর বছর যোগ ব্যায়াম করে যে ধরণের শারীরিক সামর্থ অর্জন করতে পারি, আদিম আরণ্যকরা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ভেতর দিয়েই তার চেয়ে অনেক বেশি সমর্থ হয়ে উঠতো।
দেশে দেশে বা ঋতুভেদে আরণ্যকদের জীবন অনেক আলাদা হত সন্দেহ নেই, তবে মোটের ওপর তাদের জীবন আজকের যুগের কৃষক, কারণিক বা কারখানার শ্রমিকের চেয়ে অনেক বেশি আরামদায়ক ও পরিতৃপ্তিকর ছিল বলেই মনে হয়। আধুনিক যুগে যে কোন মানুষ সপ্তাহে চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশ ঘন্টা কাজ করে। গরীব দেশে ষাট থেকে আশি ঘন্টাও বহু লোক খেটে মরে। সেখানে সবচেয়ে বৈরি পরিবেশ, যেমন কালাহারি মরুভূমির আরণ্যকরাও বড়জোর চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশ ঘন্টা কাজ করে। তারা সাধারণত তিন দিনে একদিন শিকারে বেরোয়। ফলমূল সংগ্রহ করতে দিনে তিন থেকে ছয় ঘন্টা সময় লাগে। স্বাভাবিক অবস্থায় এই যথেষ্ঠ গোত্রের সব লোকের অন্ন সংস্থান করতে। কাজেই ধরে নেওয়া যায়, যেসব আরণ্যক কালাহারির চেয়ে অনুকুল পরিবেশে থাকত, তারা খাবার এবং অন্যন্য প্রয়জোনীয় জিনিষ সংগ্রহ করতে আরো কম সময় ব্যয় করতো। তার ওপরে আরণ্যকদের ঘরের কাজ ছিল অনেক কম। তাদের থালা বাসন মাজতে হতো না, ঘর সাফ করতে হতো না, মাস গেলে বিদ্যুৎ আর গ্যাসের বিলও দিতে হতো না।
আরণ্যক অর্থনীতি, যদি এটাকে অর্থনীতির মর্যাদা দেওয়া যায়, তখনকার বেশিরভাগ আদিম স্যপিয়েন্সদের যথেষ্ঠ আকর্ষণীয় জীবন যাপনের সুযোগ দিয়েছিলো, যার একটা ভগ্নাংশও কৃষিভিত্তিক বা আজকের দিনের শিল্পভিত্তিক সমাজ আমাদের দিতে পারেনি। আজকের একজন চৈনিক শ্রমিক সকাল সাতটায় ঘর থেকে বেরিয়ে, ঘন্টা দেড়েক দূষিত রাস্তায় সময় কাটিয়ে কারখানায় পৌছায়। তারপর একই যন্ত্র একইভাবে দিনের পর দিন চালিয়ে প্রচন্ড বিরক্তিকর আট দশ ঘন্টা কাটায়। তারপর রাত সাতটা আটটার দিকে ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরে আবার লেগে যায় রান্না করতে, থালাবাসন মাজতে আর কাপড় কাঁচতে। অন্যদিকে, তিরিশ হাজার বছর আগের চৈনিক আরণ্যকের দৈনিক সময়সূচীটা ছিল এরকম। হয়ত সকাল আটটার দিকে বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে বনেবাদাড়ে মাশরুম কুড়িয়ে বেড়াতো, খাবার যোগ্য মূল উপড়ে নিত, সাপ ব্যাং ধরত আর মাঝে সাঝে সিংহের তাড়া খেয়ে দৌড়ে পালাতো। দুপুরের আগেই ফিরে এসে ‘রাঁধতে’ বসত। সে রান্না করতে দশ মিনিট লাগতো কিনা সন্দেহ। বাকী সমস্ত দিন ধরে তারা গল্পগুজব করত, বাচ্চাদের সাথে খেলত বা শুধু আয়েশ করে সময় পার করতো। মাঝে মাঝে তারা বাঘের পেটে যেতো বা সাপের কামড়ে মরত সন্দেহ নেই, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হতে হতো না, বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়ে তিলে তিলে মরত না।
এবং বেশিরভাগ সময়, প্রায় সব যায়গায় আরণ্যকদের খাদ্যাভাস আদর্শ পুষ্টির উৎস ছিল। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। লক্ষ লক্ষ বছরে মানুষের দেহ এবং খাদ্যাভ্যাস দুইই বিবর্তিত হয়েছিল আরণ্যক জীবনের সাথে খাপ খাওয়াতে। প্রাচীন মানুষের হাড়ের ফসিল বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, আরণ্যকদের মধ্যে পুষ্টিহীনতা বা দীর্ঘমেয়াদী খাদ্যের অভাব ছিল খুব কম। এরা এদের উত্তরসূরি কৃষিজীবী স্যাপিয়েন্সদের তুলনায় লম্বা আর স্বাস্থবানও ছিল। এদের গড় আয়ু সম্ভতত তিরিশ থেকে চল্লিশ বছর ছিল, কিন্তু এর কারণ ছিল শিশুমৃত্যুর উচ্চ হার। একটা শিশু জন্মে কোনভাবে বছরখানেক পার করতে পারলেই ষাট সত্তুর বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারতো অনায়েশে, কখনো কখনো আশি পঁচাশি বছরও বাড়ত।
ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতা এড়াতে আরণ্যকদের গোপন রহস্য ছিল তাদের খাদ্যাভাসের বৈচিত্র। তাদের উত্তরসূরী কৃষকদের খাদ্যাভ্যাস বিশেষ কিছু খাবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সে খাবার সুষমও ছিল না। আজকের দিনেও জনগনের বিরাট একটা অংশ এধরণের বৈচিত্রহীন খাবার খায়। তবে কৃষিবিপ্লব পরবর্তী প্রাক-আধুনিক যুগে খাদ্য-বৈচিত্রের অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়। দেহের প্রয়োজনীক ক্যালোরির বেশিরভাগই আসতো একটি মাত্র শস্য থেকে, তা হোক গম, ভুট্টা বা ধান। তাতে বিভিন্ন ভিটামিন বা খনিজ লবণ বা অন্যান্য খাদ্য উপাদানের চাহিদা অপূরণীয় থেকে যেতো। একজন চৈনিক কৃষক তিনবেলাই ভাত খায়। ভাগ্য ভাল থাকলে পরের দিনও সেই একই আহার জোটে। অন্যদিকে একজন সাধারণ আরণ্যক একই দিনে দশ বারো রকমের খাবার খেতো। সকালে যদি ফলমূল দিয়ে নাস্তা সারতো, দুপুরে হয়ত খেত খরগোশের নরম মাংস, শামুক এবং মাশরুম, রাতে ভোজ সারতো হরিণের মাংসের কাবাব পেঁয়াজ সহযোগে। পরের দিনেরই মেন্যু হয়ত হতো পুরোপুরি আলাদা। এই বৈচিত্রময়ে খাদ্যাভ্যাসের কারণে আরণ্যকরা সুষম পুষ্টি পেতো।
উপরন্তু, তারা যেহেতু যেকোন একটা খাবারের ওপর নির্ভর করতো না, তাই কোন একটা বিশেষ খাবারের ঘাটতি দেখা গেলেও তাদের খুব একটা অসুবিধা হতোনা। অন্যদিকে কৃষি যুগে বন্যা বা খরায় ফসল নষ্ট হয়ে গেলে দুর্ভিক্ষ লেগে যেতো, এখনো হয় প্রায়সই। আরণ্যকদের যে কোন রকম প্রাকৃতিক দূর্যোগ পোহাতে হতো না, বিষয়টা মোটেই তা নয়। তবে তারা সেগুল অনেক সহজে মোকাবিলা করতে পারতো। কোন কারণে জমানো খাবার নষ্ট হয়ে গেলে তারা আবার দ্রুত শিকার বা সংগ্রহ করে ফেলতে পারতো বা অন্য কোন যায়গায় সরে যেতে পারতো। তাদের তো তেমন কোন পিছুটান ছিলনা।
প্রাচীন আরণ্যকদের ভেতরে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপও ছিল অনেক কম। বেশিরভাগ প্রাণঘাতী মরণ ব্যাধি, যেমন গুটি বসন্ত, হাম, যক্ষা, ইত্যাদি স্যপিয়েন্স দেহে এসেছে গৃহপালিত প্রাণির দেহ থেকে। কৃষিবিপ্লব পরবর্তি সময়ে যখন স্যাপিয়েন্সরা বিভিন্ন পশু পোষ মানাতে শুরু করেছিল তখনই প্রথম প্রাণিদেহ থেকে মানুষের দেহে এসব জীবাণু এসেছিল। আরণ্যকদের একমাত্র পোষা প্রাণী ছিল কুকুর। তাই এসব বাজে অসুখ বিসুখ তাদের ধারে কাছে ঘেষতে পারেনি। তার ওপর কৃষি ও শিল্পযুগের বেশিরভাগ মানুষ ঘনবসতিপূর্ণ অস্বাস্থকর পরিবেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতো, যেটা ছিল মহামারীর আদর্শ অবস্থা। আরণ্যকরা ছোট ছোট দলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াতো। জীবানু সেখানে কিছুতেই ভিত গাড়তে পারতো না।
স্বাস্থকর ও বৈচিত্রময় খাদ্যাভাস, কম কাজের চাপ আর রোগ বালাইয়ের অনুপস্থিতির কারণে অনেক প্রত্নতত্ববিদ আদিম আরণ্যক সমাজকে প্রকৃত সমৃদ্ধশালী সমাজ বলে আখ্যায়িত করেন। তবে আরণ্যকদের জীবন স্বপ্নের মত সুন্দর ছিল সেরকম ভাবার কোন কারণ নেই। যদিও তারা তাদের কৃষি ও শিল্পযুগের উত্তরসূরিদের চেয়ে ভালভাবে জীবন যাপন করতো, তাদের জীবনও প্রায়ই কঠোর এবং নির্মম হতো। মাঝে সাঝে অভাব তো হতোই। শিশুমৃত্যুর হার ছিল অত্যন্ত বেশি। উপরন্তু আজকাল যেটা খুব সামান্য দুর্ঘটনা, যেমন পা মচকে যাওয়া, সেটাই ছিল তাদের জন্য যমদূত। আরণ্যক দলের বেশিরভাগ সদস্য হয়ত একে অন্যের সাথে নিবিড় আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতো, কিন্তু কোন সদস্য যদি অন্যদের বিরাগভাজন হয়ে পড়ত কোন কারণে, তার যাওয়ার আর কোন যায়গা ছিল না। বৃদ্ধ, দুর্বল বা প্রতিবন্ধী, যারা কিনা দলের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারতো না, তাদের প্রায়ই হত্যা করা হতো। অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুদের হত্যা করা হতো। দেবতার নামে মানুষ বলিও হতো।
পারাগুয়ের জঙ্গলে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত টিকে থাকে আচে নৃগোষ্ঠির জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করে নৃতাত্বিকরা আরণ্যক জীবনের অন্ধকার দিকগুলো সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে পেরেছেন। আচে সমাজের গণ্যমান্য কেউ মারা গেলে একটা ছোট্ট মেয়েকে বলি দিয়ে ওই লোকটার সাথে কবর দেওয়া হতো। নৃতাত্বিকরা একজন আচে লোকের সাক্ষাতকার নেওয়ার সময় একটা ঘটনা জানতে পারেন। এক মধ্যবয়েসী আচে লোক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে দলের লোকেরা তাকে একটা গাছের নীচে ফেলে রেখে চলে যায়। তার মাথার ওপর শকুন ঘোরাঘুরি করতে থাকে কখন লোকটার মৃত্যু হবে সে আশায়। কিন্তু কেমন করে যেন লোকটা সুস্থ হয়ে উঠলো। সে আবার দলে ফিরে এল। কিন্তু যখন এল, তার সারা শরীর ঢেকে ছিল শকুনের বিষ্ঠায়। তখন থেকে লোকটার নামই হয়ে গেল শকুনের বিষ্ঠা। আচে সমাজে কোন বৃদ্ধ নারী যখন বোঝা হয়ে যেতো, তখন তাদের পেছন থেকে মাথায় কোপ দিয়ে তাকে হত্যা করতো। সাক্ষাতকার দিতে দিতে এক আচে পুরুষ এক পর্যায়ে বলে বসল “আমি প্রায়ই বৃদ্ধ মহিলাদের খুন করতাম, আমার খালা, ফুপু অনেককেই করেছি। মহিলারা আমাকে প্রচন্ড ভয় পেতো। আজকাল সাদা চামড়ার সঙ্গে পড়ে দুর্বল হয়ে গেছি”। চুল ছাড়া যেসব শিশুর জন্ম হতো, তাদের ভাবা হতো অপরিণত আর তাদের পরিণতি হতো মৃত্যু। সাক্ষাতকারে এক নারী বলেছিলেন, তার প্রথম মেয়ে সন্তানকে নির্মমভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল কারণ দলের পুরুষরা ঠিক করেছিল যে তাদের আর মেয়ে সন্তান দরকার নেই! আরেকবার একটা বাচ্চা ছেলে খুব কাঁদছিল, আর বাবাটার ছিল মেজাজ খারাপ, ব্যাস বাচ্চাটাকে মেরে ফেললো তার নিজের বাবাই। আরেকটি শিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়া হল কারণ তার চেহারা নাকি হাস্যকর ছিল আর অন্য ছেলেমেয়েরা তাই দেখে হাসতো।
তবে চট করে বলে ফেলা যাবে না আচেদের সমজটা একদম বর্বর ছিল। যেসব নৃতাত্বিকরা বহু বছর ধরে আচেদের সাথে থেকেছেন, তারা দেখেছেন প্রাপ্তবয়ষ্ক আচেদের ভেতরে ঝগড়া বিবাদ বা মারামারি হতোনা বললেই চলে। নারী পুরুষ ইচ্ছেমত তাদের সঙ্গী পরিবর্তন করতে পারতো। তাদের মুখে হাসি লেগেই থাকতো, তাদের ভেতরে কোন রকম রাজা-প্রজা সম্পর্ক ছিলনা। তারা সবাই ছিল সমান। অন্যের ওপর খবরদারি করা মোটেই পছন্দ করতো না। তারা তাদের সামান্য যা কিছু আছে, খুশিমনে বিলিয়ে দিত যখন তখন। তারা জাগতিক সাফল্য বা সম্পদ নিয়ে একেবারেই চিন্তিত ছিলনা। তাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান ছিল পারষ্পরিক সম্পর্ক আর বন্ধুত্ব। আধুনিক সমাজের অনেকে গর্ভপাত ও মরার মত বেঁচে থাকা মানুষের স্বেচ্ছামৃত্যুক মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, সেরকম আচেরা ভাবত অবাঞ্চিত শিশ, অসুস্থ নারী পুরুষ বা বৃদ্ধদের মৃত্যুতেই তাদের মুক্তি। আর না বললেই নয় যে, আচেদেরকে পরিকল্পিতভাবে নিশ্চিহ্ন করেছিল কিন্তু প্যারগুয়ের তথাকথিত সভ্য কৃ্যকেরাই। হয়ত এধরণের শত্রুর হাত থেকে পালিয়ে বেড়াতেই দুর্বল ও অসহায়, যারা সত্যিকার অর্থেই সমাজের বোঝা হয়ে যেত, তাদের প্রতি আচেদের ব্যবহার হয়ে পড়েছিল এতটা নির্দয়। কে জানে?
আসলে অন্য যেকোন সমাজের মতই আচেদের সমাজটা ছিল খুব জটিল। সামান্য জ্ঞানের ভিত্তিতে এদের সমাজকে মহিমান্বিত করাও যেমন ঠিক হবে না, তেমনি কলঙ্কিত ভাবাও ঠিক হবেনা। তারা ফেরেশতাও ছিলনা, শয়তানও ছিলনা। তারা ছিল মানুষ। আদিম আরণ্যকেরাও তাই ছিল।
কথা বলিয়ে ভূত
আরণ্যকদের আধ্যাত্যিক জগৎ ও মনোজগৎ সম্পর্কে আমারা কতটুকু জানি? তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল এ সম্পর্কে কিছু কিছু শক্ত প্রমাণ আছে। যেমন আমরা তাদের হাড়ের ফসিল বিশ্লেষণ করে বলতে পারি তারা প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেতো কি পেতোনা। কিন্তু তারা কি খেতে ভালবাসত আর কোন খাবারটা ঠেকায় না পড়লে খেতো না, তা কি বলা সম্ভব? তাদের কাছে কি সুন্দর লাগতো? ফুল কি তখনো ভালবাসার প্রতীক ছিল? প্রিয়তমার মন পেতে কোনো পুরুষ কি বটবৃক্ষের ছায়ায় দাঁড়িয়ে প্রেমিকার পায়ে পুষ্প নিবেদন করত? বস্তুগত জীবনের তুলনায় তাদের ভাবনা, বিশ্বাস অথবা অনুভূতির জগতের রহস্যের জট খোলা অনেক বেশি কঠিন।
বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরা একমত যে আরণ্যক সমাজে animistic belief ছিল প্রবল। এর মানে তারা বিশ্বাস করত, যে কোন প্রাণী অথবা উদ্ভিদ, প্রাকৃতিক ঘটনা, পাহাড়, নদী, জঙ্গল সহ প্রায় সমস্ত জড় বস্তুরই প্রাণ আছে, তারা সচেতন ও অনুভূতিসম্পন্ন এবং তারা মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগে সক্ষম। কাজেই একজন animist খুব সহজেই বিশ্বাস করতে পারত তাদের গাঁয়ের ধারের পাহাড়ের ওপরে যে বড় পাথরটা আছে, তারও প্রাণ আছে, চাওয়া-পাওয়া আছে। পাথরটা মানুষের কোন একটা কাজে রেগে যেতে পারে আবার অন্য আরেকটা কাজে খুশিও হয়ে যেতে পারে। মানুষ তাই পাথরটাকে রাগিয়েও দিতে পারে, সন্তুষ্টও করতে পারে। animist জগতে শুধু জীব ও জড়বস্তুর প্রাণ ছিল তাই নয়, তাদের জগৎ ছিল বিদেহী আত্মা, ভূত-প্রেত, শয়তয়ান ও ফেরেসতায় ভরপুর।
Animist রা বিশ্বাস করতো যে তাদের সাথে আর সব জীবিত বস্তুর রয়েছে সরাসরি সম্বন্ধ। মন্ত্র পড়ে, নেচে গেয়ে, উৎসব করে এদের সাথে সংযোগ স্থাপন করা যায়। একজন শিকারী একটা হরিণ দলের কাছে আবেদন করতে পারতো তাদের একজনকে উৎসর্গ করতে। বধ করা শিকারের কাছে আবার ক্ষমাও চেয়ে নিতে পারত। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ওঝা নানা রকম মন্ত্র পড়ে, আচার অনুষ্ঠান করে যে আত্মা এই অসুখ দিয়েছে তাকে খুশি করত বা তাড়িয়ে দিত। দরকার হলে ওঝা সে আত্মার সাহায্যও চাইতে পারত। একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এসব আত্মারা সবাই ছিল এলাকাভিত্তিক, আরণ্যকদলের আশেপাশেই তারা বিচরণ করতো। সেখানে সর্বত্র বিরাজমান কোন ঈশ্বর ছিলনা, ছিল বিশেষ একটা হরিণ, একটা সিংহ, একটা নদী বা একটা ভূত।
Animist সমাজে মানুষ এবং এসব আত্মাগুলোর মধ্যে ছিলনা কোন রকম উঁচুনিচু ভেদাভেদ। অন্য আত্মাগুলো যে শুধু মানুষের উদ্দেশ্যে নিবেদিত, ব্যপারটা মোটেই সেরকম ছিলনা। সেখানে ছিল না কোন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যার ইচ্ছে অনুযায়ী সব কিছু চলতো। মানুষের জন্যই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে, এমনটাও তারা ভাবত না।
Animism বিশেষ কোন ধর্মের নাম নয়, বরং হাজারো রকমের প্রচলিত ধর্মের একটা সাধারণ নাম, যেসব ধর্মে এরকম বিশেষ দৃষ্টিতে বিশ্বপ্রকৃতিকে দেখা হয়। আরণ্যকরা যদি animistic হয়ে থাকে তাহলে পরবর্তীকালের কৃষিভিত্তিক স্যাপিয়েন্স সমাজ ছিল ঈশ্বরবিশ্বাসী। তার মানে এদের সমাজে ছিল সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, ছিল মানুষের চেয়ে উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত অবতার, যাদের অনুগ্রহে চলত মানুষ। এখনো বেশিরভাগ স্যাপিয়েন্স ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। Animism এর মত ঈশ্বরবিশ্বাসও বিশেষ কোন ধর্ম নয়। আঠেরোশ’ শতকের পোল্যান্ডের ইহুদী রাব্বাই, সতেরোশ’ শতকের ম্যাসাচুসেটসের ডাইনি-পোড়ানো খৃস্টান, পনেরশ’ শতাব্দীর বর্তমান মেক্সিকোর আজটেক পুরুত, বারোশ’ শতকের ইরানের সুফি সাধক, দশম শতাব্দীর ভাইকিং যোদ্ধা, দ্বিতীয় শতকের রোমান সৈন্যদল আর প্রথম শতাব্দির চৈনিক আমলা, সবাই এর ভেতরে পড়বে। এরা সবাই নিজের বিশ্বাসটাকে সত্যি বলে ভাবে আর অন্যেরটাকে ভাবে অদ্ভুত এবং ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসঘতকতার সামিল। Animist দের বিশ্বাস এবং আচারের মধ্যেও নিশ্চই এরকম বিস্তর ফারাক ছিল। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসও হয়ত নানা রকম বিতর্কের সম্মুখীন হত আবার সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হত।
তবে এক্ষেত্রে প্রত্নতাত্বিকদের দৌড় সাধারণভাবে সব animist দের এক কাতারে ফেলে দেওয়ার ভেতরেই সীমাবদ্ধ। বিশেষ কোন একটা আরণ্যক ধর্ম বা আচার সম্পর্কে কিছু বলতে যাওয়া হবে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার সামিল। কারণ কিছু ফেলে যাওয়া জিনিষপত্র আর গুহাচিত্র ছাড়া এবিষয়ে আমাদের হাতে আর কোন রকম প্রমাণ নেই। এসব জিনিষ ও গুহাচিত্রগুলোর নির্দিষ্ট কোন অর্থ বের করাও মুশকিল। যেসব বিশেষজ্ঞরা আদিম আরণ্যকদের মনোজগৎ এবং আধ্যাত্যিকতা সম্পর্কে নানা রকম তত্ব হাজির করেন, তাদের কথায় ভরসা করা খুব কঠিন।
গুটিকয় গুহাচিত্র আর সামান্য কিছু প্রত্নতাত্বিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে তত্বের পাহাড় না গড়ে সরারসি স্বিকার করে নেওয়াই ভাল যে আদিম আরণ্যকদের ধর্ম ও আধ্যাত্যিকতা বিষয়ে আমাদের জ্ঞান অত্যন্ত ভাষাভাষা। আমরা ধরে নেই যে তারা animist, কিন্তু এটা তেমন কোন বিশেষ অর্থ বহন করেনা। তারা কোন অদৃশ্য আত্মায় বিশ্বাস করত, কি ধরণের আচার পালন করতো, কি কি উৎসব পালন করতো, এগুলো কিছুই আমরা জানিনা। বিশেষ করে বলতে হয়, আমরা জানিনা তারা কি ধরণের গল্প বলতো, তাদের কল্পিত-বাস্তবতার স্বরূপ কি ছিল। মানবজাতির ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় ফাঁক।
আরণ্যকদের সামাজিক-রাজনৈতিক জীবন হচ্ছে আরেকটা ক্ষেত্র যে বিষয়ে আমরা প্রায় কিছুই জানিনা। আগেই বলা হয়েছে, বিশেষোজ্ঞরা এক্ষেত্রে মৌলিক বিষয়, যেমন সম্পদের অধিকার ছিল কিনা, পরিবার কাঠামো কেমন ছিল, তারা কি একগামী না বহুগামী ছিল, এগুলো নিয়েই এখনো একমত হতে পারেননি। আবার গোত্রে গোত্রে এবিষয়গুলোর ভিন্নতা থাকাটাও স্বাভাবিক। কোন কোন গোত্রে হয়ত ছিল রাজা-প্রজা সম্পর্ক, প্রতিযোগীতার মনোভাব আর যুদ্ধংদেহী ভাব, ঠিক শিম্পাঞ্জিদের মত। অন্যদিকে কোন কোনটা হয়ত ছিল বেবুন গোত্রের মত সাম্যবাদী, বন্ধুসুলভ ও শান্তিপ্রিয়।

১৫,০০০ – ২০,০০০০ বছর আগেকার গুহাচিত্র। আমরা চিত্রটিতে কি দেখছি আর এর আসলে মানে একটা পাখির মাথাবিশিষ্ট মানুষকে একটা বাইসন আক্রমাণ করছে। তার পেছনে আছে একটি পাখি। হয়তো এই পাখিটি সাধারণ কোন পাখি নয়।, হয়তো এটা পাখি মানবের দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া আত্মা। আমরা কি করে নিশ্চিত হব? কোন উপায় নেই।
১৯৫৫ সালে প্রত্নতাত্বিকরা রাশিয়ার সানগিরে তিরিশ হাজার বছর আগের ম্যামথ শিকারীদের একটা কবরখানা খুঁজে পান। একটা কবরে আনুমানিক পঞ্চাশ বছর বয়সী একজন পুরুষের হাড়ের ফসিল খুঁজে পাওয়া যায়, যার সারা গায়ে পরানো ছিল ম্যামথের দাঁতের পুতির মালা, সব মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার পুতি পাওয়া গিয়েছিল সে মালাগুলোতে। তার মাথায় ছিল শেয়ালের দাঁতের তৈরি মুকুট আর হাতে ছিল ম্যামথ দাঁতের তৈরি পঁচিশটি বালা। আশেপাশের অন্য কবরের মালিকদের অলংকারের বহর এর ধারে কাছেও ছিলনা। প্রত্নতাত্বিকরা ধারণা করেন যে সানগিরের আরণ্যকদের সমাজটা শ্রেণীবিভক্ত ছিল। আর ঐ লোকটা খুব সম্ভব ওই গোত্রর নেতা ছিল। হয়ত সে অনেকগুলো গোত্রের নেতা ছিল। একটা গোত্রের কয়েক ডজন লোকের পক্ষে তাদের নেতার সৎকারে এত এত অলংকার জোগাড় করাটা অত সহজ ছিল বলে মনে হয়না।
নৃতাত্বিকরা এর পর আরো কৌতুলহলোদ্দীপক একটি কবর খুঁজে পান। সেখানে দুটি ছেলেমেয়ের একসাথে কবর হয়েছিল। মারা যাওয়ার সময় ছেলেটির বয়স ছিল বারো কি তেরো আর মেয়েটির নয়-দশ। ছেলেটার গায়ে জড়ানো ছিল পাঁচ হাজার ম্যামথ-দাঁতের পুতির মালা। তারও মাথায় ছিল শেয়াল দন্ত শোভিত মুকুট আর কোমরে ছিল দু’শ পঞ্চাশটি শেয়াল-দন্তের বেল্ট। কমপক্ষে ষাটটা শেয়ালের দাঁত টেনে তুলতে হয়েছিল এতগুলো দাঁত জোগাড় করতে। মেয়েটির গায়ে জড়ানো মালার পুতির সংখ্যা ছিল ৫,২৫০। তাদের চারপাশে সাজানো ছিল নানারকম মূর্তি আর ম্যমথ-দাঁতের তৈরি নানারকম তৈজসপত্র আর অলংকার। তখনকার দিনে একটা পুতি গড়তে একজন কারুশিল্পির যদি পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লেগে থাকে তাহলে শুধু ওই পুতিগুলো বানাতেই লেগেছিল প্রায় সারে সাত হাজার ঘন্টা। একজন অভিজ্ঞ কারুশিল্পির তিন বছরের কাজ! অন্য জিনিষগুলোর কথা নাহয় বাদই দিলাম। এত কম বয়েসের দুই শিশু সানগিরির আরণ্যক গোত্রের নেতা হয়ে গিয়েছিল, সেটা একটু হাস্যকর শোনায়। সানগিরের লোকেরা কি বিশ্বাসে একাজ করেছিল, বলা মুশকিল। একটা ব্যাখ্যা হচ্ছে, এরা ছিল তাদের নেতার বংশধর। হয়ত সানগিরে রাজবংশের রেওয়াজ চালু ছিল। তাই রাজপুত্র-রাজকন্যা মৃত্যুর পর পেয়েছিল রাজসিক মর্যাদা। আরেকটা তত্ব হচ্ছে, সেখানকার মানুষ হয়ত এই দুই শিশুর মাঝে তাদের কোন বিশিষ্ট পূর্বপুরুষের পূনর্জন্ম দেখতে পেয়েছিল। তৃতীয় আরেকটা তত্ব হচ্ছে, এদেরকে কোন একটা ধর্মীয় আচারের অংশ হিসাবে বলি দেওয়া হয়েছিল।
যেটাই সত্যি হোক না কেন। সানগিরের এই আবিষ্কারে একটা বিষয় কিন্তু পরিষ্কার। তিরিশ হাজার বছর আগেও স্যাপিয়েন্সরা অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা হয়ে, ডিএনএর মৌলিক প্রেরণাকে ডিঙ্গিয়ে গিয়ে, জটিল সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছিল।

আর্জেন্টিনায় আবিষ্কৃত হস্ত গুহার গুহাচিত্র। আনুমানিক ৯,০০০ বছর আগের আরণ্যকদের হাতের ছাপে তৈরি এই চিত্র। দেখে মনে হচ্ছে, পাথরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা কতগুলো হাত আমাদের ছুঁতে চাইছে। দেখলেই কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। কিন্তু এর কি মানে, কে জানে?
যুদ্ধ না শান্তি?
পরিশেষে প্রাচীন আরণ্যকদের জীবনে যুদ্ধের ভূমিকা কতটুকু ছিল এই অস্বস্তিকর প্রশ্নটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। কোন কোন বিশেষজ্ঞ ধারণা করেন তাদের সমাজটা ছিল শান্তির স্বর্গ। তাদের মতে কৃষি বিপ্লবের পর থেকে যখন ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক সম্পদের ধারণার সূচনা হল, সম্পাদের অধিকার পেতে তখন থেকেই যুদ্ধ বিগ্রহের সূচনা। অন্য অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন আরণ্যক সমাজ ছিল অবিশ্বাস্য রকমের নিষ্ঠুর ও হিংস্র। দুটো তত্বেরই ভিত্তি খুব দুর্বল। সামান্য কিছু প্রত্নতাত্বিক নজির আর আধুনিক আরণ্যক সমাজ পর্যবেক্ষণ করে এধরণের জোরালো মতামত দেওয়া উচিত নয়।
এ সংক্রান্ত নৃতাত্বিক প্রমাণগুলো খুব কৌতুহলোদ্দীপক তবে মোটেই পরিষ্কার নয়। আগেই বলা হয়েছে আধুনিক আরণ্যকরা সাধারণত চরম ও প্রতিকূল পরিবেশে বসবাস করে, যেমন উত্তর মেরু বা কালাহারি মরুভূমি। এসব যায়গায় মানুষের ঘনত্ব খুব কম, তাই যুদ্ধ বিগ্রহের সম্ভাবনাও কম। যুদ্ধ করতে হলে অন্য দলের মুখোমুখি তো অন্তত হতে হবে। তার উপরে, আধুনিক আরণ্যকদের দেশের আইন অনুযায়ী চলতে হয় প্রায় ক্ষেত্রেই, তাই স্বতস্ফূর্ত যুদ্ধ বিগ্রহের সুযোগটা কম। ইওরোপিও বিশেষজ্ঞরা মাত্র দুইটা আধুনিক আরণ্যক সমাজ পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল বেশি। উনিশ শতকের উত্তর পশ্চিম আমেরিকায় আর উনিশ শতক ও বিংশ শতকের গোড়া অব্দি উত্তর অস্ট্রেলিয়ায়। এই দুটো সমাজেকে যথাক্রমে আমেরিন্ডিয়ান ও এবরিজিনাল নামে ডাকা হয়। আমেরিন্ডিয়ায়ন ও এবরিজিনাল সমাজে ঘন ঘন সশস্ত্র যুদ্ধ হতো। এখানে অবশ্য একটা বিতর্ক আছে। এই যুদ্ধ কি আদিকাল থেকে চলে আসছিল নাকি এটা ছিল ইওরোপিয় উপনিবেশের ফল? আমরা জানিনা।
অন্যদিকে প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ খুবই সামান্য এবং একই সাথে অস্পষ্ট। দশ বিশ হাজার বছর বা তারো আগে যদি যুদ্ধ হয়েও থাকে, তার কিইবা প্রমান অবশিষ্ট থাকতে পারে আজ অবধি? তখন তো পাথরের দূর্গ বা সুরক্ষা দেয়াল ছিলনা। এমনকি তলোয়ার বা বর্মও ছিলনা। প্রাচীন তীর ধনুক যুদ্ধে ব্যবহার হয়েও থাকতে পারে, কিন্তু শিকারের কাজেও ব্যবহার হতে পারে। হাড়ের ফসিলের মানেও একই রকম ধোঁয়াটে। যুদ্ধে হাড় ভাঙ্গতে পারে অথবা নিতান্ত সাধারন কোন দুর্ঘটনার কারণেও ঘটতে পারে। আবার হাড়ের ফসিলে কোনো আঘাত না থাকলেই বলার কোন উপায় নেই যে, লোকটার শান্তিপূর্ন মৃত্যু হয়েছিল। হাড় ছাড়া অন্য অংগে আঘাত লেগে মারা পড়লে তার ছাপ তো হাড়ে থাকার কথা নয়। প্রাক-শিল্পযুগের যুদ্ধে বেশিরভাগ মানুষ মারা যেতো দুর্ভিক্ষ, মহামারী বা ঠান্ডায়, তলোয়ারের আঘাতে নয়। তাহলে সে তো আরণ্যক যুগেও হতে পারে। কল্পনা করুন, তিরিশ হাজার বছর আগে দুই গোত্রের যুদ্ধে পরাজিত গোত্রের সবচেয়ে সক্ষম লোকদের মেরে ফেলা হলো। তাতে করে সে গোত্রের বাকী লোকদের ক্ষুধায় মারা পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি হত, তাইনা? প্রত্নতাত্বিকরা যদি ক্ষুধায় মারা পড়া এসব লোকের হাড়ের ফসিল খুঁজে পান, তারা ভেবে বসতে পারেন যে কোনো একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগে এদের মরণ হয়েছিল। তারা কি করে বুঝবেন তাদের মৃত্যুর কারণ ছিল নিষ্ঠুর যুদ্ধ?
আমরা বুঝলাম যে প্রত্নতাত্বিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে খুব সাবধান হতে হবে। এখন দেখা যাক কি ধরণের প্রমাণ বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছেন। পর্তুগালে কৃষি যুগ পূর্ববর্তী চারশ’ কংকালের ওপর একটা সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। মাত্র দুটো কংকালে হিংস্রতার পরিষ্কার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল। ইসরায়েলে আরো চারশ একই রকম কংকাল পরীক্ষা করে মাত্র একটা কংকাল পাওয়া গিয়েছিল, যার খুলিটা ছিল ফাটা। এটা হয়ত হিংস্রতার কারণে হয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে দানিয়্যুব নদীর উপত্যকায় আরো চারশ প্রাচীন আরণ্যকের হাড় পর্যবেক্ষণ করে আঠেরোটিতে এধরনের সম্ভাব্য হিংস্রতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আঠেরোটা শুনতে খুব বেশি শোনায় না, তবে শতকরা হিসাবে এই সংখ্যাটা অনেক বড়। যদি আঠেরো জনের সবাই আসলেই হিংস্রতার বলি হয়ে থাকে তাহলে দানিয়্যুব উপত্যাকার প্রতি একশ জনে সাড়ে চার জন হিংস্রভাবে মারা গিয়েছিল। আজকের বিশ্বে যুদ্ধ বিগ্রহ, অপরাধ সব কিছু মিলিয়ে এই হার মাত্র দেড় শতাংশ। বিংশ শতকে এই হার ছিল পাঁচ শতাংশ, আমাদের জানার মধ্যে যেটা কিনা ছিল মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত শতাব্দী।
এটাই শেষ নয়। এরকম মন খারাপ করা একের পর এক প্রত্নতাত্বিক নজির প্রকাশ পেতে লাগল। সুদানের যাবল সাহাবায় বারো হাজার বছরের পুরোনো একটা সমাধিক্ষেত্র আবিষ্কৃত হল। সেখানে উনষাটটি কঙ্কাল ছিল। এর মধ্যে চব্বিশটি বা চল্লিশ শতাংশ কংকালের হাড়ে বিদ্ধ হয়ে অথবা পাশে পড়ে ছিল ধনুকের ফলা। একটা নারী কঙ্কালে বারোটা আঘাতের চিহ্ন ছিল। জার্মানীর বাভারিয়ার ওফটেনের এক গুহার ভেতরে আটতিরিশটি কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই ছিল নারী ও শিশু। এদের মধ্যে অর্ধেক কঙ্কালের দেহেই মুগুর অথবা ছুড়ির আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। সেখানে যে কয়েকটা পুরুষ কঙ্কাল ছিল, সবগুলোতেই ছিল ভয়াবহ অত্যাচারের চিহ্ন। এসব দেখে প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে অফটেনের এই লোকগুলো ছিল যুদ্ধ ও গণহত্যার শিকার। তাদের মেরে ওই গুহায় ফেলে রাখা হয়েছিল।
তাহলে আদিম আরণ্যকদের সম্পর্কে কোন কথাটা সত্যি? তারা কি ইসরায়েল বা পর্তুগালে পাওয়া কঙ্কালের মালিকদের মত শান্তিপ্রিয় নাকি যাবল সাহারাহ বা অফটেনের ভাগ্যহত মানুষগুলো যে কলহপ্রিয় সমাজে বাস করতো, তাদের মত? কোনোটাই না। ঠিক যেমন আদিম আরণ্যকদের ধর্ম এবং সামাজিক কাঠামো ছিল বৈচিত্রময়, একইভাবে হয়ত বিভিন্ন আরণ্যক সমাজে যুদ্ধ বিগ্রহের মাত্রাটাও বিভিন্ন রকম ছিল। কোনো কোনো এলাকার আরণ্যকরা হয়ত শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করেছে আর অন্য এলাকার আরণ্যক সমাজের অধীবাসীরা ঘনঘন দ্বন্দ-কলহে মেতে থেকেছে।
নিঃশব্দের পর্দা
যেখানে আদিম আরণ্যক সমাজ সম্পর্কে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়েই এত বিতর্ক, সেখানে এবিষয়ে বিস্তারিত জানাটা অসম্ভব বললেও ভুল হবেনা। স্যাপিয়েন্স দল যখন প্রথম নিয়ান্ডার্থালদের এলাকায় পৌছায়, তার পরপরই হয়ত শুরু হয়ে গিয়েছিল যুদ্ধ আর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। দুঃখজনকভাবে সেরকমটা যদি হয়েও থাকে, আমাদের পক্ষে সেটা জানা প্রায় অসম্ভব। হয়ত পাওয়া যাবে কিছু আঘাতপ্রাপ্ত ফসিল বা পাথরের যুদ্ধাস্ত্র, বিজ্ঞনীরা যত গভীরভাবেই গবেষণা করুক না কেনো, এসব প্রমাণগুলোকে তো আর কথা বলা যাবেনা। ফসিলগুলো থেকে আমরা মানুষের শারিরীক গঠন জানতে পারি, তাদের খাদ্যাভ্যাস অনুমান করতে পারি, তাদের প্রযুক্তি কেমন ছিল বোঝার চেষ্টা করতে পারি, এমনকি তাদের সামাজিক কাঠামো সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা করতে পারি। কিন্তু আমরা কেমন করে জানব গোত্রে গোত্রে কি ধরণের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল, কোন ঈশ্বর, আত্মা বা ভুতপ্রেতে তারা বিশ্বাস করতো, কি বিশ্বাসে তারা অলংকারে সাজিয়ে দিতো মৃতদেহ?
এই নিঃশব্দের পর্দা কালের হিসাবে ইতিহাসের বেশিরভাগটাই ঢেকে রেখেছে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে। হারিয়ে যাওয়া সুদীর্ঘ সে সহস্রাব্দ জুড়ে হয়ত চলেছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর বিল্পব, হয়ত চলেছে এখনকার মতই ধর্মীয় উন্মাদনা। তখনকার জ্ঞানীগুণীরা হয়ত গভীর সব দর্শনের জন্ম দিয়েছিলেন, শিল্পিরা তৈরি করেছিলেন নান্দনিক শিল্পকর্ম। হয়ত আরণ্যকদের নেপোলিয়ান জয় করে নিয়েছিল গোত্রে পর গোত্র, তাদের বেথোফেনের হয়ত পিয়ানো বা বেহালা ছিলনা, কিন্তু হয়তো সে বাঁশির মূর্ছণায় পাগল করে দিতে পারতো। তাদের অবতাররা হয়ত তাদের বনবিবির বাণী সাধারনের কাছে পৌছে দিতেন। কিন্তু আমাদের এসব জানার কোন উপায় নেই। আমরা বড়জোর অনুমান করতে পারি। নিঃশব্দের পর্দাটা এতই ভারি, এসব ঘটনা আদৌ ঘটেছিল কিনা সেবষয়েই আমরা ঠিকমত জানিনা, এগুলোর বিষদ বর্ণনা করা তো সুদূরপরাহত।
যেসব বিষয়ে অন্তত সন্তোষজনক ধারণা মিলতে পারে, বিশেষজ্ঞরা শুধু সেসব প্রশ্ন নিয়েই গবেষণা করেন। এধরণের গবেষনার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক উন্নতি না হলে আমরা কখনোই আদিম আরণ্যকদের মানসিক, আধ্যাত্বিক বা রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতে পারব না। তবে উত্তর না থাললেও এই প্রশ্নগুলো কিন্তু জরুরী। তা না হলে আমারা গত ষাট সত্তুর বছরের ইতিহাস হেসে উড়িয়ে দিতে পারি এই ভেবে যে, তখনকার স্যাপিয়েন্সরা গুরুত্বপূর্ণ কিছুই করেনি।
সত্যটা হল, তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। আদিম আরণ্যকরা আমাদের জন্য ঠিক কিভাবে জগতটাকে গড়ে দিয়ে গেছে, সাদা চোখে আমরা তা দেখতে পাইনা। সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা, মধ্য অস্ট্রেলিয়ার বৈরি মরুভূমি আর আমাজনের গহীন অরণ্যে পৌছে দুঃসাহসী অভিযাত্রিরা ভেবেছে এই প্রথম সেখানে কোন মানুষের পা পড়ল। তাদের এই ভুল বারংবার ভেঙ্গেছে। আরণ্যকরা আমদের বহু আগেই এসব যায়গায় পৌছে গেছে এবং সেসব যায়গার পরিবেশ পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। পরের অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব, কিভাবে কৃষি বিপ্লবের বহু আগেই আমাদের আরণ্যক পূর্বপুরুষেরা এই পৃথিবীর প্রকৃতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিল। এখনকার তুলনায় মুষ্টিমেয় আরণ্যক যাযাবর দল তখনকার প্রাণীজগতের জন্য ছিল সবচেয়ে বড় অভিশাপ।
