November 7, 2016

পর্ব ১ - স্যাপিয়েন্সঃ মানবজাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস | চতুর্থ অধ্যায়

বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব – চতুর্থ অধ্যায়

ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা

বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের আগে পর্যন্ত সব প্রজাতির মানুষই বাস করতো আফ্রো-ইউরেশিয়ার অখন্ড ভূমিতে। এটা সত্যি যে তারা সাঁতরে পার হয়ে অথবা ভেলায় চেপে আশেপাশের কিছু দ্বীপে পৌঁছুতে পেরেছিল। যেমন ফ্লোরেস দ্বীপে প্রায় সাড়ে আটলক্ষ বছর আগে থেকেই মানুষের বসতি ছিল। তবে তারা কেউই খোলাসাগরে নৌকা ভাসাতে সাহস করেনি। তাই বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব-পূর্ববর্তী উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মাদাগাস্কার, নিউজিল্যান্ড বা হাওয়াই-এর মত দূরবর্তী দ্বীপে মানুষের পা পড়েনি। সাগরের এই বাধার কারণে শুধু মানুষ কেন, আফ্রো-ইউরেশিয়ার অন্য কোন প্রাণীও কোনোভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি এসব ‘নতুন দুনিয়ায়’। তার ফলে এসব বিচ্ছিন্ন এলাকায় কোটি কোটি বছর ধরে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের বিকাশ ঘটেছিল। আফ্রো-ইউরেশিয়ার জীবজগতের সাথে এদের কোন সম্বন্ধই ছিলনা। তখন পৃথিবীতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমাবেশে গঠিত ভিন্ন ভিন্ন অনেকগুলো বাস্তুজগত ছিল। পৃথিবীটা ছিল অনেক বেশি বৈচিত্রময়। বুদ্ধিমান হয়ে উঠে হোমো স্যাপিয়েন্সরা উঠে পড়ে লেগেছিল এই বৈচিত্রের শেষ দেখে নিতে।

বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের ফলে স্যাপিয়েন্সরা দূর সমুদ্রযাত্রার প্রয়োজনীয় সবকিছু পেয়ে গেল – উন্নত প্রযুক্তি, শক্ত সাংগঠনিক ভিত আর অজানার পথে পা বাড়ানোর মনের জোর। তাদের প্রথম সাফল্য ছিল পঁয়তাল্লিশ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় বসত গড়তে পারা। কি করে স্যপিয়েন্সরা তখনকারে দিনে এই দুঃসাধ্য সাধন করল, ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞদের ঘাম ঝরে যাওয়ার যোগাড়। অস্ট্রেলিয়া পৌঁছুতে স্যাপিয়েন্সদের অনেকগুলো সাগরপথ পাড়ি দিতে হয়েছিল, যার কোনো কোনোটা ছিল শত শত মাইল দীর্ঘ। আবার সেখানে পৌঁছে দিনে দিনেই তাদের সম্পূর্ণ নতুন একটা বাস্তুজগতের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছিল।

সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যুক্তিটা হচ্ছে, পঁয়তাল্লিশ হাজার বছর আগে ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপূঞ্জের অধিবাসী স্যাপিয়েন্সরা সাগর পারে থাকতে থাকতে ক্রমশ সমুদ্রযাত্রায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। তারা মজবুত সমুদ্রগামী জাহাজ বানাতে ও চালাতে শিখল। তারপর গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার আর দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে বাণিজ্য করে বেড়াতে শুরু করলো। স্যাপিয়েন্সদের এহেন সাফল্য ছিল প্রাকৃতিক বিবর্তনকে কাঁচকলা দেখানোর সামিল। অন্য যেসব স্তন্যপায়ী প্রাণী, যেমন ডলফিন বা তিমি, এদের সবাইকে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হতে হয়েছে স্থায়ীভাবে জলের বাসিন্দা হতে। যেমন তিমি মাছের নাকটা বিবর্তিত হয়ে মাথায় উঠে এসেছে নিঃশ্বাস নেবার সুবিধার্থে, ডলফিনের দেহটা সুগঠিত হয়েছে ভাল সাঁতার কাটার জন্য। অন্যদিকে এইপের বংশধর স্যাপিয়েন্স, যারা কিনা সেই সেদিন আফ্রিকার সাভানা থেকে এসেছে, কোন রকম বিবর্তনের ঝক্কি না পুহিয়েই সাগর পাড়ি দিতে শিখল। পাখনা আর কানকোর বদলে তারা বানালো জাহাজ আর শিখে নিলো জাহাজ চালানো।

এটা সত্যি যে প্রত্নতত্ত্ববিদরা পঁয়তাল্লিশ হাজার বছর আগের নৌকা বা জেলেপাড়া এখনো খুঁজে পাননি। সেটা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিনও হবে, কারণ সে সময়কার ইন্দোনেশিয়ার উপকূল আজ শত শত মিটার পানির নীচে চলে গেছে। তবে এই তত্ত্বের পেছনে শক্ত পরোক্ষ প্রমাণ আছে। অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছাবার পর থেকে তারা একের পর এক পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় দূর্গম দ্বীপ দখল করতে শুরু করে। এর কোনো কোনোটা, যেমন বাকু ও মানুস দ্বীপ অন্য যে কোন স্থলভূমি থেকে অন্তত দুইশ কিলোমিটার দূরে ছিল। নব্য অস্ট্রেলিয়রা সমুদ্রভ্রমণে পটু ছিল, এটা তার একটা জোড়ালো ইঙ্গিত বহন করে। উন্নত নৌযান বা নৌচালনায় পারদর্শিতা ছাড়া বাকু ও মানুসের মত গভীর সমুদ্রের দ্বীপ দখল করার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ ছিল। আগেই বলা হয়েছে দুর্গম দ্বীপগুলো, যেমন নিউ আয়ারল্যান্ড আর নিউ ব্রিটেনের মধ্যে বাণিজ্যের প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়।

অস্ট্রেলিয়ায় স্যাপিয়েন্সদের পদার্পণ মানবজাতির ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা, অন্ততঃ  কলম্বাসের আমেরিকা জয় অথবা অ্যাপোলো ১১-এর চাঁদে পা রাখার মত গুরত্বপূর্ণ। এই প্রথম কোন মানুষ, বলতে গেলে কোন স্থলজীবী প্রাণী, আফ্রো-ইউরেশিয়ার বাস্তুজগতের বাইরে পদার্পণ করলো। অস্ট্রেলিয়ায় পা রেখে তারা যা করলো, সেটা তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। অস্ট্রেলিয়ার সাগর সৈকতে নৌকা ভেড়ানোর সাথে সাথেই মানুষ আরেকটা নতুন বাস্তুজগতের খাদ্যশৃঙ্খলের চূড়ায় উঠে বসলো। এর অর্থ হলো, কোটি কোটি বছর ধরে যেসব প্রাণী দিব্যি চড়ে খাচ্ছিল, তাদের মৃত্যুদূত হাজির হলো দোরগোড়ায়। স্যাপিয়েন্সরা ক্রমশ পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে মরণঘাতী প্রাণী হয়ে উঠছিল। অস্ট্রেলিয়াতে এসে সেটা পাকাপোক্ত হলো।

এর আগে পর্যন্ত মানুষ বেশ কিছু মৌলিক অভিযোজন ক্ষমতা আর ব্যবহারিক পরিবর্তন এনেছিল পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য, তবে পরিবেশের ওপর তাদের প্রভাব ছিল নগণ্য। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে সেখানকার প্রকৃতির সঙ্গে দ্রুত সফলভাবে খাপ খাওয়াতে পারতো, কিন্তু পরিবেশে কোন দীর্ঘমেয়াদী পরবর্তন আনতে পারত না। অস্ট্রেলিয়ায় বসতিস্থাপনকারীরা, সত্যি করে বলতে গেলে অস্ট্রেলিয়ার ঔপনিবেশিকরা, যে সেখানে শুধু খাপ খাইয়ে নিয়েছিল সেটা বললে ভুল হবে। তারা অস্ট্রেলিয়ার বাস্তুজগতে এমন সব পরিবর্তন এনেছিল যে পুরানো চেহারার সাথে এই ‘নতুন’ অস্ট্রেলিয়ার আর কোন মিলই রইলো না।

অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রসৈকতে প্রথম স্যাপিয়েন্সের পদচিহ্ন নিশ্চয় পরদিনের জোয়ারেই মুছে গিয়েছিল। কিন্তু তারা অস্ট্রেলিয়ার জমিতে একের পর এক যে পদচিহ্ন এঁকে গেল, সেগুলো কোনদিনই আর মুছে ফেলা যাবেনা। তার অস্ট্রেলিয়ার যতই ভেতরে ঢুকতে লাগল, ততই দেখা পেতে থাকল অদ্ভুত সব জন্তুজানোয়ারেরঃ দুইশ কিলোগ্রাম ওজনের ক্যাঙ্গারু যার উচ্চতা ছিল দুই মিটার, বিশালাকার মারসুপিয়াল সিংহ যেটা ছিল অস্ট্রেলিয়ার সবচেয় মারাত্বক মাংসাশী প্রাণী, বিশালাকায় কোয়ালা যেগুলো ছিল আজকের দিনের ছোট্ট আদর জাগানো কোয়ালার তুলনায় বহুগুণে বড় আর অস্ট্রিচের চেয়ে দ্বিগুন আকারের হেঁটে বেড়ানো পাখি। ড্রাগন আকৃতির সরীসৃপ আর দশহাত লম্বা সাপ ওঁত পেতে থাকত ঝাড়-জংলার নীচে। জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো দানবাকৃতির diprotodon (জলহস্তী আর ভালুকের মাঝামাঝি একটি প্রাণী) আর আড়াইটনি wombat (দেখতে অনেকটা কাঠবেড়ালির মত)। পাখি এবং সরিসৃপ ছাড়া অন্য সব প্রাণীই ছিল মারসুপিয়াল (marsupial), ঠিক ক্যাঙ্গারুর মত। এরা ছোট্ট অপরিণত বাচ্চার জন্ম দিত, তারপর সেই বাচ্চাকে পেটের থলিতে রেখে দুধ খাইয়ে বড় করতো। মারসুপিয়ালদের আফ্রিকা বা ইউরেশিয়ায় কেউ কখনো চোখেই দেখেনি, কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে এরা রাজত্ব কায়েম করেছিল স্যাপিয়েন্স আসার আগে পর্যন্ত।

স্যাপিয়েন্সরা অস্ট্রেলিয়ায় আসার কয়েকহাজার বছরের ভেতরে বেশিরভাগ মারসুপিয়াল একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। অস্ট্রেলিয়াতে পঞ্চাশকেজির বেশি ওজনদার চব্বিশটি প্রজাতির প্রাণী ছিল, এর ভেতরে তেইশটিই বিলুপ্ত হয়ে গেলো। বেশিরভাগ ছোট আকৃতির প্রজাতিও ধ্বংস হয়ে গেলো। অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ লক্ষ বছরের খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙ্গে গেল কয়েক হাজার বছরের ব্যবধানে, তৈরি হল নতুন ধরণের খাদ্যশৃঙ্খল। এই দায়ভার কি স্যাপিয়েন্সদের?

অন্যায়ের প্রমাণ

কিছু বিজ্ঞানী স্যাপিয়েন্সদেরকে এই ভয়ংকর অন্যায়ের দায় থেকে নিষ্কৃতি দিতে চান। তাঁরা বলেন এ ছিল প্রকৃতির খেয়াল। তবে এই যুক্তি মানা কঠিন। তিনটি কঠিন যুক্তি দিয়ে এই ভিত্তিহীন যুক্তি ধূলোয় মিশিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপুল প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করার দায়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের দায়ী সাব্যস্ত করা যায় ।

প্রথমত, যদিও পঁয়তাল্লিশ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ুতে কিঞ্চিত পরিবর্তন এসেছিল। তবে এই পরিবর্তন কি করে এরকম বিশালাকারের বিলুপ্তি ঘটালো সেটা একেবারেই পরিষ্কার নয়। আজকাল জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর সবকিছুর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। তবে সত্যিটা হচ্ছে, পৃথিবীর জলবায়ু সবসময়ই পরিবর্তিত হচ্ছে (এখানে বলে রাখা উচিৎ, ইদানিং মানুষ এই পরিবর্তন তরান্বিত করছে)। পৃথিবীর সমস্ত ঘটনাই ঘটে এই পরিবর্তনশীল জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে।

বিশেষত, আমাদের পৃথিবী একটা উষ্ণায়ন ও শৈত্যায়ন চক্রের ভেতর দিয়ে চলে সবসময়ই। গত দশ লক্ষ বছর ধরে গড়ে প্রতি এক লক্ষ বছরে একটা করে বরফযুগ এসেছে। সব শেষ বরফযুগটা এসেছিলো আনুমানিক পঁচাত্তর হাজার থেকে পঁচিশ হাজার বছর আগে। একটা বরফযুগে প্রায়শ দু’বার তীব্র শীত পড়ে। গত বরফযুগে প্রথম তীব্র শীত পড়েছিল প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে আর দ্বিতীয়টা এসেছিল মোটামুটি বিশ হাজার বছর আগে। দানবাকৃতির diprotodon পৃথিবীতে এসেছিল প্রায় পনেরো লক্ষ বছর আগে, তার মানে অন্তত দশটা বরফযুগ এরা সফলভাবে মোকাবিলা করে এসেছিলো। তাহলে ঠিক পঁয়তাল্লিশ হাজার বছর আগেই কেন এদের বিলুপ্তি ঘটলো? শুধু যদি diprotodon হতো, তাহলে এতো বড় গলায় দাবি করা যেতোনা যে এর পেছনে স্যাপিয়েন্সদের হাত আছে। অস্ট্রেলিয়ার নব্বই শতাংশ বড় প্রাণীই চলে গেলো এদের সাথে সাথে। প্রমাণটা পরোক্ষ সন্দেহ নেই, কিন্তু বিশ্বাস করা খুব কঠিন যে লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়ার বড় প্রাণীগুলো ঠিক যে সময় ঠান্ডায় মারা পড়ছিল, সে মুহূর্তটাই স্যাপিয়েন্সরা অস্ট্রেলিয়া জয় করতে বেছে নিয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, জলবায়ুর পরিবর্তন যখন স্থলজীবী প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটায়, সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর জলবায়ুর প্রভাবটা তখন হয় আরো মারাত্বক। কিন্তু পঁয়তাল্লিশ হাজার বছর আগে সামুদ্রিক প্রাণীর বিলুপ্তির কোন রকম প্রমাণ নেই। শুধুমাত্র মানুষের হস্তক্ষেপ একমাত্র গ্রহণযোগ্য যুক্তি। মানুষের কারণেই অস্ট্রেলিয়ায় স্থলজীবি প্রাণীর বিলুপ্তি হয়েছিলো। মানুষ পারেনি, তাই বেঁচে গিয়েছিল আশপাশের সামুদ্রিক প্রাণীর দল। জলপথের সাথে তখন বেশ পরিচিত হয়ে উঠলেও স্যাপিয়েন্সরা ছিল মূলত স্থলের উপদ্রব।

তৃতীয়ত, অস্ট্রেলিয়ার গণবিলুপ্তির মত ঘটনা এর পর বারেবারে ঘটেছে, যখনই স্যাপিয়েন্সরা নতুন কোন ভূখন্ডে বসতি গেড়েছে তখনই। এসব ক্ষেত্রে স্যাপিয়েন্সদের দায় অনস্বীকার্য। যেমন নিউজিল্যান্ডের বড় প্রাণী, যেগুলো পঁয়তাল্লিশ হাজার বছর আগের তথাকথিত জলবায়ুর পরিবর্তন সয়ে দিব্যি বেঁচে রয়েছিল, তারা প্রথম মানুষের আগমনের সাথে সাথে দ্রুতগতিতে সরে গেল পৃথিবীর মঞ্চ থেকে। নিউজিল্যান্ডের প্রথম স্যাপিয়েন্স অধিবাসী মাউরিরা আজ থেকে মাত্র আটশ বছর আগে সেখানে পৌঁছায়। দুই শতাব্দীর ভেতরেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো নিউজিল্যান্ডের প্রায় সমস্ত বড় প্রাণী আর ষাট শতাংশ পাখী।

উত্তর মেরুর কাছাকাছি সাইবেরিয়ার সৈকত থেকে দুইশ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত র‍্যাংগ্যাল দ্বীপের ম্যামথদের পরিণতিও তাই হয়েছিলো। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ম্যামথরা ইউরেশিয়ায় রাজত্ব করেছিলো। কিন্তু যেখানেই স্যাপিয়েন্সরা গেছে ম্যামথরা পিছু হটে গেছে। দশ হাজার বছর আগে অখন্ড ইউরেশিয়ায় একটাও ম্যামথ বাকি ছিলনা। কিছু ম্যামথ টিকে ছিলো উত্তর মেরুর কাছাকাছি দ্বীপগুলোতে, বিশেষত র‍্যাংগ্যাল দ্বীপে। র‍্যাংগ্যালের ম্যামথরা আরো কয়েক হাজার বছর বেঁচে ছিল। মাত্র চার হাজার বছর আগে তারা বিলুপ্ত হয়ে গেলো, ঠিক যখন মানুষের পা পড়লো ওই দ্বীপে।

অস্ট্রেলিয়ার ঘটনাটা যদি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হত, তাহলে হয়ত স্যাপিয়েন্সদের ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দেওয়া যেতো। কিন্তু যেভাবে একের পর এক গণবিলুপ্তি ঘটেছে স্যপিয়েন্সদের আগমনের সাথে সঙ্গতি রেখে, তাতে এদের শুধু খুনি না, বরং সিরিয়াল কিলার বলতে হয়।

অস্ট্রেলিয়ার ঔপনিবেশিকদের কাছে পাথরের অস্ত্রের চেয়ে উন্নততর কোন প্রযুক্তি ছিলোনা। তাহলে কি করে তারা এত ব্যাপক একটা কান্ড ঘটালো? এবিষয়েও তিনটি ধারালো যুক্তি আছে।

গণবিলুপ্তির মূল ভুক্তভোগী ছিল বড় প্রাণী। এসব প্রাণীর বংশবিস্তারের গতি খুব ধীর। দীর্ঘ সময়ব্যাপী এরা গর্ভাবস্থায় থাকে, প্রতি গর্ভে সন্তান বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে কম। উপরন্তু দুই গর্ভের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হয় দীর্ঘ। কাজেই মানুষ যদি দু’তিন মাস পর পরও একটা করে diprotodon মেরে থাকে, তাদের জন্মের চেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যেতে সেটাই যথেষ্ঠ ছিল। এভাবে কয়েক হাজার বছরেই শেষ diprotodon-টি মারা যাওয়ার সাথে সাথেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো এই প্রজাতি।

তবে আকারে বড় হলেও অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীগুলোকে মারতে স্যাপিয়েন্সদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি বলেই ধারণা করা হয়। তারা তো আর দুপেয়ে এই উপদ্রবের সাথে মোটেই পরিচিত ছিলনা। বিশ লক্ষ বছর ধরে বিভিন্ন প্রজাতির মানুষ সারা আফ্রিকা আর ইউরেশিয়ায় চড়ে বেড়িয়েছে। ধীরে ধীরে তাদের শিকারের দক্ষতা বেড়েছে। চার লক্ষ বছর আগে তারা প্রথম বড় প্রাণী শিকার করা শুরু করেছে। তাই এখানকার বড় প্রাণীগুলো বুঝে গিয়েছিলো এই দুপেয়ে প্রাণীরা কতটা বিপদজনক। তাই এরা মানুষের মত প্রাণীর কাছ থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে শিখে গিয়েছিলো।

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার বড় প্রাণীদের এবিষয়ে কোন ধারণাই ছিলোনা। স্যাপিয়েন্সরা দেখতেও তো মোটেই ভয়ানক ছিলোনা। তাদের না ছিল ধারালো শ্বদন্ত, না ছিল পেশীবহুল বলিষ্ঠ দেহ। তাই diprotodon-রা প্রথম যখন এই দুর্বল চেহারার নতুন ধরণের ‘শিম্পাঞ্জির’ মুখোমুখি হলো, তখন হয়তো এক নজর দেখেই  ঘাসপাতা চিবুতে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। মানুষের ভয় জিনে ঢুকে যেতে সময়ের প্রয়োজন। সেই সময়টুকু তারা পেলোনা।স্যাপিয়েন্সরা  ততদিনে শিকারে এত দক্ষ হয়ে গিয়েছিলো যে এরা স্যাপিয়েন্সেদের হাত থেকে পালিয়ে বেড়াতে শেখার সময়টুকুও পেলো না, তাই বেঘোরে মারা পড়লো।

আরেকটা ব্যাখ্যা হলো, অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগেই স্যাপিয়েন্সরা বন পুড়িয়ে চাষ করার কায়দা রপ্ত করে নিয়েছিলো। অস্ট্রেলিয়ার অপরিচিত পরিবেশে ভয় পেয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে হয়তো তারা বনের পর বন পুড়িয়ে নাশ করেছিল, সৃষ্টি করেছিল তৃণভূমি, যেখানে ঘুরে বেড়াতো সহজে শিকারযোগ্য প্রাণীর দল। তাই কয়েক হাজার বছরের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার বিরাট অংশজুড়ে বাস্তুজগতে আমূল পরিবর্তন চলে আসল।

গাছের ফসিল আমাদের এই তত্ত্ব সমর্থন করে। অস্ট্রেলিয়ায় ইউক্যালিপ্টাস গাছ খুব একটা ছিলনা। আগুনে অন্যান্য অনেক প্রজাতির গাছ পুড়ে গেল। ইউক্যালিপ্টাসের আগুন সহ্য করার ক্ষমতা অনেক বেশি, তাই খোলা ময়দানে ইউক্যালিপ্টাস গাছের সংখ্যা হুহু করে বাড়তে লাগলো। এর ফলে তৃণভোজী প্রাণীদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনে বিরাট পরিবর্তন এলো, ফলে এদের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মাংসাশী প্রাণীর জীবনেও এলো ব্যাপক পরিবর্তন। ইউক্যালিপ্টাস পাতাখেকো কোয়ালাদের জনসংখ্যা ফুলেফেঁপে উঠলো। অন্যান্য অনেক তৃণভোজী প্রাণী ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। খাদ্যশৃঙ্খলের নিম্নস্তরে থাকা অনেক তৃণভোজী প্রাণীর বিলুপ্তির ফলে এদের ওপর গড়ে ওঠা খাদ্য শৃঙ্খলগুলোও ধ্বসে পড়লো।

তৃতীয় আরেকটা ব্যাখ্যা হচ্ছে, শিকার আর আগুনের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের যুগপৎ আক্রমণ। জলবায়ুর তো তখন পরিবর্তন হচ্ছিলই। আর জলবায়ুর পরিবর্তনের সময় জীবজগৎ সাধারণত কিছুটা নিরপাত্তাহীন ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এর আগে এসব প্রাণী বিভিন্ন কৌশলে এ পরিবর্তন মোকাবিলা করেছিলো। কিন্তু এবার এই জটিল পরিস্থিতির সাথে যোগ হলো স্যাপিয়েন্সদের অত্যাচার। নানা দিক থেকে একযোগে আক্রমণ মোকাবিলার কৌশল খুঁজে পাওয়া ভার। তাই এরা পালিয়ে বাঁচার পথ পেলোনা।

ওপরের এই তিনটা ঘটনার কোনটা আসলে ঘটেছিলো, সে বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসা হয়তো সম্ভব নয়। তবে মানুষ যদি কৌতুহলী হয়ে দক্ষিণে পা না বাড়াতো, তাহলে আজো সেখানে ঘুরে বেড়াতো মারসুপিয়াল সিংহ, diprotodon আর দৈত্যাকৃতির ক্যাঙ্গারু, একথা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

বিশ্ববিজয়

অস্ট্রেলিয়ার বড় প্রাণীকুলের অবলুপ্তি সম্ভবত ছিল পৃথিবীর ওপর স্যাপিয়েন্সদের প্রথম চিরস্থায়ী বড় আঘাত। এর চেয়েও বড় আঘাতটা এলো আমেরিকার ভূখন্ডে। হোমো স্যাপিয়েন্সরা ছিল প্রথম এবং একমাত্র মানব প্রজাতি যারা আমেরিকায় পা রেখেছিল। সেটা প্রায় ষোল হাজার বছর আগের ঘটনা। প্রথম আমেরিকানরা পায়ে হেঁটেই আমেরিকায় এসেছিলো। সেটা সম্ভব হয়েছিল কারণ তখন সমুদ্রতল নেমে গিয়েছিলো অনেকটা নীচে। তখন সাইবেরিয়ার উত্তর-পূর্ব  আর আলাস্কার উত্তর-পশ্চিম সীমানার মধ্যে পথ বেরিয়ে গিয়েছিল। সে যাত্রা মোটেই সুখকর ছিলনা, বরং ছিল কঠিন ও বিপদসংকুল, সম্ভবত নৌকায় চেপে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার চেয়েও কঠিন। এই পথ পাড়ি দিতে স্যাপিয়েন্সদের প্রথম শিখতে হয়েছিল কি করে উত্তর সাইবেরিয়ার চরম জলবায়ুতে টিকে থাকতে হয়, যেখানে শীতে কখনো সূর্য ওঠেনা আর তাপমাত্রা শূন্যের নীচে পঞ্চাশ ডিগ্রি অবধি নেমে যেতে পারে।

এর আগে অন্য কোন মানব প্রজাতি উত্তর সাইবেরিয়া পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেনি। এমনকি ঠান্ডা সইতে পারা নিয়ান্ডার্থালরা পর্যন্ত দক্ষিণ সাইবেরিয়ার অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চল অবধি এসে থেমে গিয়েছিল। কিন্তু স্যাপিয়েন্সরা, যারা আফ্রিকার উষ্ণ সাভানায় বেড়ে উঠেছিল, তারাই কিনা উত্তর সাইবেরিয়া অভিযানে বেরোলো। প্রচন্ড ঠান্ডা মোকাবিলা করতে তারা আবিষ্কার করেছিল চতুর সব কৌশল। স্যাপিয়েন্স দল যতই উত্তরে যেতে থাকল, তারা নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে লাগল। তারা শিখল কি করে সুই দিয়ে নিশ্ছিদ্রভাবে সেলাই করা পরতের পর পরত চামড়া আর লোমের পোষাক পরে আর বরফের জুতা পায়ে দিয়ে শরীর উষ্ণ রাখা যায়। উত্তরাঞ্চলের ম্যামথ আর অন্যান্য বড় প্রাণী শিকার করার জন্য তারা নতুন ধরণের অস্ত্র এবং উন্নত কৌশল আবিষ্কার করলো। তাদের শীতপোষাক আর শিকারের কৌশল যত উন্নত হতে লাগলো, স্যাপিয়েন্সরা ততই পৌঁছে যেতে লাগল সাইবেরিয়ার গভীর থেকে আরো গভীরে।

কিন্তু কেন এত কষ্ট শিকার করে স্যাপিয়েন্সরা এই উত্তরমুখি যাত্রা অব্যাহত রেখেছিল? হয়তো যুদ্ধ, জনসংখ্যার চাপ অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের বাধ্য করেছিল। আবার ভাল শিকারের আশায়ও তারা এটা করে থাকতে পারে। উত্তর সাইবেরিয়া ম্যামথ আর রেইনডিয়ারের মত মোটাতাজা প্রাণীতে পরিপূর্ন ছিল। একটা ম্যামথ থেকেই পাওয়া যেত টনকেটন মাংস। আবার ঠান্ডায় সে মাংস জমিয়ে সংরক্ষণও করা যেত। আরো পাওয়া যেত সুস্বাদু চর্বি, শরীর গরম রাখার জন্য চামড়া ও লোম এবং গহনা বানানোর জন্য মহামূল্য দাঁত। সানগিরে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনাগুলোই বলে দেয়, সাইবেরিয়ার ঠান্ডায় তারা যে শুধু বেঁচে ছিল তা নয়, বরং মহাসমারোহে রাজত্ব করেছিল। ম্যামথ, মাস্টাডন, রেইনডিয়ার আর গন্ডার ধাওয়া করতে করতে স্যাপিয়েন্সরা ক্রমাগত দূর থেকে দূরে পৌছে যেতে লাগল। এভাবে ধাওয়া করতে করতেই চৌদ্দ হাজার খৃস্টপূর্বাব্দের দিকে কোনোভাবে তারা চলে এলো আলাস্কায়। ম্যামথ এবং মানুষ দুজনের জন্যই আলাস্কা তখন ছিল সাইবেরিয়ারই একটা অংশ মাত্র।

প্রথমদিকে হিমবাহ আলাস্কাকে আমেরিকার বাকি অংশ থেকে আলাদা করে রেখেছিল। কিন্তু বারো হাজার খৃস্টপূর্বাব্দ থেকে উষ্ণায়নের ফলে সে বরফ গলতে শুরু করে আর আমেরিকার দরজা খুলে যায় স্যাপিয়েন্সদের কাছে। সে পথ ধরে দলে দলে স্যাপিয়েন্স আমেরিকার দক্ষিণ দিকে চলে আসতে থাকল। দ্রুত তারা উত্তর আমেরিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। যদিও এরা উত্তর মেরুর ঠান্ডা জলবায়ুতে বসবাসের জন্য অভিযোজিত হয়েছিল, খুব দ্রুত তারা আমেরিকার বিচিত্র ধরণের জলবায়ু ও বাস্তুজগতের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হলো। সাইবেরিয়দের বংশধরেরা বর্তমান আমেরিকার উত্তরের গহীন জঙ্গল, মিসিসিপি নদীর পাললিক বদ্বীপ, মেক্সিকোর উত্তপ্ত মরুভূমি আর মধ্য আমেরিকার আর্দ্র ও উষ্ণ জঙ্গল, এই সব জায়গাই জয় করে নিল। কেউ কেউ ঘর হিসাবে বেছে নিল আমাজন নদীর কূল আর কেউবা ঘাটি গাড়লো আন্দিজ পর্বতের চূড়ায়। দশ হাজার খৃস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণের দ্বীপ তিয়েররা দেল ফুয়েগো (আগ্নেয়ভূমি) পর্যন্ত স্যাপিয়েন্সদের বসতি গড়া হয়ে গিয়েছিলো। আমেরিকার উত্তর থেকে দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত স্যাপিয়েন্সদের এই সদর্প পদচারনা তাদের অতি উন্নত অভিযোজনক্ষমতা আর অতুলনীয় উদ্ভাবনীশক্তির সাক্ষ্য বহন করে। পৃথিবীর অন্য কোন প্রাণী একই জিন নিয়ে এত বিচিত্র সব জলবায়ু আর বস্তুজগতে এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারেনি।

অহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে স্যাপিয়েন্সরা আমেরিকা জয় করেছিলো, এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। উত্তর থেকে দক্ষিণে স্যাপিয়েন্সদের সুদীর্ঘ যাত্রাপথ রাঙ্গা হয়েছে অগণিত জীবজন্তুর রক্তে। আমেরিকার প্রাণীজগত চৌদ্দ হাজার বছর আগে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ্ব ছিল। আলাস্কা থেকে কানাডা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে যেতে যেতে মানুষ ম্যামথ আর মাস্টাডনের দেখা তো পেলই, আরো দেখতে পেল ভালুকের মত বড় ইঁদুর, ঘোড়া আর উটের দল, বিশালাকৃতির সিংহসহ ডজন ডজন বড় প্রাণী, যেগুলো সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই নেই। আরো ছিল  লম্বা শ্বদন্তবিশিষ্ট বিশালাকৃতির ভয়ংকর বনবেড়াল আর দৈত্যাকৃতির স্লথ, যাদের ওজন ছিল আট টনের মত আর উচ্চতা ছিল প্রায় ছয় মিটার। দক্ষিণ আমেরিকায় ছিল এর চেয়েও অদ্ভুত ও বৈচিত্র্যময় স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ আর পাখির রাজত্ব। আমেরিকা ছিল বিবর্তনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর একটা উর্বর ক্ষেত্র। আমেরিকার ভূখণ্ড অন্যসব মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্নধারায় প্রাণের বিবর্তন ঘটেছিল।

কিন্তু সেটা চিরস্থায়ী হলনা। স্যাপিয়েন্সরা আমেরিকা দখল করে নেয়ার দুই হাজার বছরের ভেতরে সেখানকার বেশিরভাগ স্বতন্ত্র প্রজাতি চিরতরে হারিয়ে গেল। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, আমেরিকার সাতচল্লিশটি বড় প্রাণীর গণের মধ্যে চৌত্রিশটই বিলুপ্ত হয়েছে এই স্বল্প সময়ের মধ্যে। শ্বদন্তি বেড়াল (আসলে একে বাঘ বললেই মানায় বেশি) তিন কোটি বছর ধরে আমেরিকার মাটিতে রাজত্ব করে চলে গেল স্যাপিয়েন্সদের  আগমনের পরপরই, গেলো আমেরিকার সিংহ, গ্রাউন্ড স্লথ, ইঁদুর, ম্যামথ, যেগুলো সবই ছিল এখনকার হিসাবে দৈত্যাকৃতির। আরো গেল আমেরিকার ঘোড়া আর উট। হাজারো রকমের ছোটো আকারের স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ, এমনকি ছোট ছোট পোকামাকড় আর পরজীবীও গেল একই সাথে। যেমন, ম্যামথ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় ম্যামথের গায়ে বসে থাকা সব রকমের উকুন জাতীয় পোকাও বিলুপ্ত হল।

Palaeontologist আর zooarchaeologist-দের কাজ হচ্ছে প্রাচীন আমলের প্রাণীর দেহাবশেষ খুঁজে বের করে সেগুলো নিয়ে গবেষণা করা। বহু বছর ধরে তাঁরা আমেরিকার বন পাহাড়ে চিরুনী অভিযান চালিয়ে হারিয়ে যাওয়া এসব চমৎকার প্রাণীর চিহ্ন খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। এসব প্রাণীর হাড় বা মলের ফসিল খুঁজে পাওয়া মাত্র সেগুলো সাবধানে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গবেষনাগারে। সেখানে প্রতিটি নিদর্শন নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করা হয়। গবেষণায় বারে বারে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে উঠে আসছে। সবচেয়ে নতুন হাড় এবং মলের নমুনাগুলো তখনকার, যখন মানুষ ধীরে ধীরে আমেরিকা গ্রাস করে নিচ্ছিলো, আনুমানিক বারো হাজার খৃস্টপূর্বাব্দ থেকে নয় হাজার খৃস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। শুধু কয়েকটি জায়গায় বিজ্ঞানীরা এরচেয়ে নতুন মলের ফসিল খুঁজে পেয়েছেন, যেমন ক্যারিবীয় দ্বীপগুলোতে, বিশেষত কিউবা আর হিস্পানিওলায়। সেখানে বিজ্ঞানীরা সাত হাজার বছর আগের দৈত্যাকার স্লথের মল খুঁজে পেয়েছেন, ঠিক যে সময় মানুষ সাগর পাড়ি দিয়ে এই দুই দ্বীপে বসতি গেড়েছিল।

এখানেও কিছু বিজ্ঞানী স্যাপিয়েন্সদের দায়মুক্ত করতে চান জলবায়ু পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে। তাদের কথা মানলে ধরে নিতে হয় যে সাত হাজার বছর ধরে কোন এক যাদুমন্ত্রবলে ক্যারিবীয় জলবায়ুর পরিবর্তন হয়নি, যদিও তখন পুরো উত্তর গোলার্ধে  উষ্ণায়ন চলছিল, স্যাপিয়েন্সের পদার্পনের সাথে সাথেই যে যাদুর মায়া কেটে গেল। কিন্তু যুক্তিশীল মানুষের পক্ষে মলের এই অকাট্য প্রমাণ অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। আমরাই অপরাধী। এটা অনস্বীকার্য। জলবায়ুর পরিবর্তন এই গণ বিলুপ্তির প্রক্রিয়া যদি শুরু করেও থাকে, আমরা সেটা একশ ভাগ সম্পূর্ন করেছি।

নূহ নবীর বজরা

আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়ায় গণবিলুপ্তি, আফ্রো-ইউরেশিয়ার অন্যান্য সব মানব প্রজাতির বিদায় আর কিউবা আর হিস্পানিওলার মত বিভিন্ন দ্বীপে স্যাপিয়েন্সদের বসতি স্থাপনের কারণে ছোট ছোট বিলুপ্তি, এ সব কিছু চিন্তা করলে এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে স্যাপিয়েন্সরা প্রথম ধাক্কায় যে বিশ্বজয় করেছিল, তার ফলে প্রাণীজগতসহ পুরো বাস্তুজগত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছিল রোমশ প্রাণীগুলোর ওপর। বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের শুরুতে পৃথিবীতে বড় স্থলচর প্রাণীর প্রায় দুইশ গণ (মানে হাজারের ওপরে প্রজাতি) ছিল, যাদের গড় ওজন ছিল পঞ্চাশ কেজির বেশি। কৃষিবিপ্লবের শুরুতে এই সংখ্যা একশতে নেমে আসে। আজকের দিনে যা নিতান্ত মামুলি ব্যাপার যেমন, চাকা, লেখা এবং লোহার সরঞ্জাম, ইত্যাদি আবিষ্কার হওয়ার আগেই হোমো স্যাপিয়েন্সরা পৃথিবীর অর্ধেক বড় প্রাণী উধাও করে দিতে সক্ষম হয়েছিল।

slide11
বৈজ্ঞানিকদের ধারণা অনুযায়ী শিল্পীর কল্পনার তুলিতে আঁকা। সামনে আছে দৈত্যাকৃতির স্লথ, পেছনে আছে দৈত্যাকৃতির আর্মাডিলো। দুটি প্রজাতিই আজ বিলুপ্ত

বাস্তুজগতে এধরণের করুণ কাহিনি বারবার রচিত হয়েছে কৃষিবিপ্লব পরবর্তী যুগে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা দ্বীপের পর দ্বীপে এই একই দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তির প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন। ঠিক যেন একটা সাজানো নাটক। প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় প্রকৃতির কোলে খেলে বেড়াচ্ছে মানুষ ছাড়া ছোটবড় নানারকম প্রাণী। দ্বিতীয় পর্বে আগমন ঘটে স্যাপিয়েন্স নামক দু’পেয়ে প্রাণীর। আর তৃতীয় দৃশ্যে স্যাপিয়েন্সরাই হয়ে যায় নাটকের মূল চরিত্র, আর ছোটবড় বেশিরভাগ প্রাণী হারিয়ে যায় মঞ্চ থেকে।

আফ্রিকার মূল ভূখন্ড থেকে চারশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মাদাগাস্কার দ্বীপের ঘটনাটা এখানে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আলাদা থাকার কারণে সেখানে বিচিত্র সব প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল, যেগুলো পৃথিবীর আর কোথাও ছিল না। যেমন আধটন ওজনের আর তিন মিটার উচ্চতার এলিফ্যান্ট বার্ড, বিশালদেহী লিমুর। পনেরোশ বছর আগে হঠাৎ করে এলিফ্যান্ট বার্ড আর লিমুরসহ মাদাগাস্কারের অনেক ছোটবড় প্রাণীর দল উধাও হয়ে গেল, ঠিক যখন স্যাপিয়েন্সদের পদার্পন ঘটেছিল এই দ্বীপে।

প্রশান্ত মহাসগরীয় দ্বীপগুলোতে এই বিলুপ্তির প্রক্রিয়া শুরু হয় এক হাজার পাঁচশ খৃস্টপূর্বাব্দে, যখন থেকে পলিনেশিয়ার কৃষকরা বসতি গাড়তে শুরু করে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ফিজি আর নিউ কালেদোনিয়ায়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্যাপিয়েন্সরা সেখানে মেরে ফেলেছিল শত শত পাখি, শামুক, পোকামাকড়সহ  দ্বীপের নানারকম বাসিন্দাকে। সেখান থেকে বিলুপ্তির স্রোত ছড়িয়ে পড়ে প্রথমে পূর্ব দিকে আর সেখান থেকে উত্তর ও দক্ষিণ হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের দুর্গমতম দ্বীপে। সেই ধ্বংসের পরিক্রমায় একে একে গেছে সামোয়া আর টোংগা (১২০০ খৃস্টপূর্বাব্দে), মার্কিজ দ্বীপপুঞ্জ, ইস্টার দ্বীপ, কুক দ্বীপপুঞ্জ আর হাওয়াই (৫০০ খৃস্টাব্দে) আর সবশেষে নিউজিল্যান্ডের (১২০০ খৃস্টাব্দে) প্রাণীজগতের বিরাট অংশ।

বাস্তুজগতের ধ্বংস ঘটেছে প্রশান্ত মহাসাগরে মালার মত ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার ছোট দ্বীপপুঞ্জে, ভারত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর, ভূমধ্যসাগর আর আর্কটিক মহাসাগরের  সমস্ত দ্বীপে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম দ্বীপে নানা রকম পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর হাড় খুঁজে পেয়েছেন, যেগুলো সেসব  দ্বীপে প্রথম কৃষক আসার আগে পর্যন্ত অনাদিকাল ধরে হেসেখেলে বেড়িয়েছিল। শুধু কয়েকটা দুর্গমতম দ্বীপ স্যাপিয়েন্সদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে গ্যালাপাগোস দ্বীপ। ১৯০০ শতকের আগে পর্যন্ত এই দ্বীপ মানুষের অগোচরে ছিল। ফলে সেখানে রয়ে গিয়েছিল বিচিত্র সব প্রাণী, যেমন দানবাকৃতির কচ্ছপ, যারা মানুষকে ভয় পেতে শেখেনি, ঠিক অস্ট্রেলিয়ার diprotodon এর মতই।

জীবজগতে বিলুপ্তির প্রথম ধাক্কা এসেছিল আরণ্যকদের বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে, দ্বিতীয় ধাক্কাটা এসেছিলো কৃষির বিস্তারের সাথে সাথে, আর তৃতীয় ধাক্কাটা এখনো চলছে, যার শুরু শিল্পযুগের হাত ধরে। যেসব পরিবেশবাদী বলে বেড়ায় যে আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিল প্রকৃতির সন্তান, তাদের কথা মোটেই বিশ্বাস করবেন না। শিল্পবিপ্লবের হাজার হাজার বছর আগেই জীবজগতের সবচেয়ে বিধ্বংসী শক্তি হিসাবে আমাদের সুনাম হয়ে গিয়েছিল। জীবজগতের ইতিহাসে আমরাই ছিলাম (এবং এখনো আছি) সবচেয়ে মারাত্মক প্রজাতি।

হয়তো প্রথম ও দ্বিতীয় বিলুপ্তির ধাক্কা সম্পর্কে আমরা যদি জানতাম, তাহলে অবিবেচকের মতো তৃতীয় ধাক্কাটা ঘটতে দিতাম না। আমরা যদি জানতাম আমরা কত হাজার হাজার প্রজাতির প্রাণী ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত করে ফেলেছি, তাহলে হয়ত বেঁচে যাওয়া প্রাণীগুলোর প্রতি আরেকটু সদয় হতাম, বিশেষ করে বড় সামুদ্রিক প্রাণীদের প্রতি। সামুদ্রিক জীবগুলো বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব আর কৃষি বিপ্লবের সময় স্থলচর প্রাণীদের তুলনায় বেশ নিরাপদে ছিল। কিন্তু মানুষের সামুদ্রিক সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আর মানুষ্যসৃষ্ট বর্জ ও দূষণের কারণে এরা আজ বিলুপ্তির পথে। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে অচিরেই তিমি, ডলফিন, টুনা আর হাঙ্গর তাদের পূর্বসুরি diprotodon আর ম্যামথের পথ ধরবে। বেঁচে থাকবে শুধু মানুষের একটি প্রজাতি, হোমো স্যাপিয়েন্স, আর তাদের সেবায় নিয়োজিত মুষ্টিমেয় গৃহপালিত পশুর দল, যাদের ভূমিকা নূহ নবির বজরায় দাঁড়টানা কৃতদাসের চেয়ে বেশি কিছু নয়।

স্যাপিয়েন্সঃ মানবজাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
Sapiens: A Brief History of Humankind by Yuval Noah Harari