June 4, 2014

'উন্নতির মানসিকতা' কি, শিশুদের এই মানসিকতা গড়ে তোলা কেন জরুরী এবং কিভাবে আমরা তা করতে পারি?

ব্যক্তিগত একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। আমি আগে বেশ কয়েকবার বিদেশী ভাষা শিখতে গিয়ে লজ্জাজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছি। ছয় মাস ফরাসি ভাষার ক্লাস করে ক্ষ্যান্ত দিয়েছি। জার্মান ভাষার ক্লাস মোটে দুই সপ্তাহ করেই লেজ গুটিয়ে পালিয়েছি। চার পাঁচ বছর আগে সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসাবে হাতে নেই স্প্যানিশ ভাষা শিক্ষা প্রকল্প। এবার নামলাম স্বশিক্ষার স্পৃহা নিয়ে। তাও গড়ালো মেরেকেটে তিন চার মাস। প্রতিবার যে সমস্যাটা আমাকে কাবু করে ফেলতো, সেটা হচ্ছে একটা ভাষার বিশালত্ব। বাংলা ইংরেজী তো ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে বহু বছর ধরে শিখেছি। তাই এখন মোটামুটি কাজ চালাতে পারি। কিন্তু হঠাৎ করে বুড়ো বয়েসে নতুন একটা ভাষা কতটুকু শিখতে পারব, আর সেই সামান্য শেখা কতটুকু কাজে লাগবে, এসব চিন্তা সব সময় নতুন একটা ভাষা শেখার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে দিতো। বছর তিনেক আগে হঠাৎ করে মনে হল, শেখাটা কাজে লাগুক আর নাই লাগুক, চেষ্টাটা তো চালিয়ে যেতে পারি। আমার আশেপাশে তখন প্রচুর স্প্যানিশভাষী লোক। আর কিছু না হোক, অন্তত হাই হ্যালোটা তো করতে পারব। স্প্যানিশ গান ভাল লাগে খুব, কিছু শব্দ জানলে গানগুলোর ভাবতো একটু ধরতে পারব। তাই ধূলা ঝেড়ে আবার হাতে নিলাম স্প্যানিশ বইগুলো। প্রতিদিন দুইটা চারটা নতুন শব্দ শেখা, একটুখানি ব্যকরণ শেখা, দশ মিনিট একটা স্প্যানিশ টিভি সিরিয়াল দেখা, এই করে এগুতে লাগলাম। শেখার আনন্দেই শিখে যেতে লাগলাম। কিছুদিন পর অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমি বেশ দ্রুত উন্নতি করছি। বিন্দু থেকে যে সিন্ধু হয় তার হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম। বছরখানেকের ভেতরেই আমি স্প্যানিশ ভাষায় হ্যারি পটারের বইগুলো পড়তে শুরু করলাম (মানছি হ্যারি পটার আমার মোটামুটি মুখস্থ, তবুও) আর ভাঙ্গাভাঙ্গা স্প্যানিশে দিব্যি বাক্যালাপ চালিয়ে যেতে শিখলাম। নতুন ভাষা শেখার ক্ষেত্রে আমার এই পরিবর্তিত মানসিকতার একটা নাম আছে। একে বলা হয় Growth Mindset বা উন্নতির মানসিকতা, যদিও আমি না জেনেই ভাষা শিক্ষার ব্যপারে এই মানসিকতাটা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

মানুষ কিভাবে জীবনে সফলতা অর্জন করে এই বিষয়ে আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ক্যারল ডওয়াক বহু বছর ধরে গবেষণা চালান। তিনি দেখতে পান, পৃথিবীতে মূলত দুই ধরণের মানুষ আছে, একদলের আছে উন্নতির মানসিকতা বা Growth Mindset আর আরেকদলের আছে স্থির মানসিকতা বা Fixed Mindset। এই দুই দলের মধ্যে পার্থক্য কি?

উন্নতির মানসিকতার লোকজন বিশ্বাস করে মানুষের দক্ষতা বা বুদ্ধিমত্তা কোনো স্থির বিষয় নয়। চেষ্টা করলে মানুষ নিশ্চই তার দক্ষতা এবং বুদ্ধিমত্তার উন্নতি করতে সক্ষম। অন্যদিকে স্থির মানসিকতার লোকেরা এবিষয়ে প্রচন্ড সন্দিহান। তারা অবচেতনভাবে বিশ্বাস করে যে বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার উন্নতি করা খুব কঠিন। স্থির মানসিকতার লোক ব্যর্থতাকে ভয় পায়। তারা মনে করে কিছু একটা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে সেটা খুব লজ্জার এবং অযথা শক্তির অপচয়। আর উন্নতির মানসিকতার মানুষ ব্যর্থতাকে মোটেই ভয় পায়না, তারা জানে প্রতিবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার সাথে সাথে একটু একটু করে শেখা হয়। তাই স্থির মানসিকতার মানুষ নতুন কিছু করা, শেখা বা সমস্যার সমাধানের প্রকৃয়াটা মোটেই উপোভোগ করেনা, তাদের মনে কাজ করে অপারগতা নিয়ে সন্দেহ আর ব্যর্থতার ভয়। উন্নতির মানসিকতার মানুষ এই প্রকৃয়াটাকে উপভোগ করে কোনো রকম ফলের চিন্তা না করেই। এর ফলে স্থির মানসিকতার লোক নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগগুলো গ্রহণ করেনা, এক জায়গায় পড়ে থাকে। অন্যদিকে উন্নতির মানসিকতার লোক এসব সুযোগের সদব্যবহার করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

ভায়োলিন বাজানো, গলফ খেলা, লেখা, যন্ত্রপাতি বানানো, গুছিয়ে কথা বলা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সাইকেল চালনা ইত্যাকার যেকোন দক্ষতা ভালভাবে অর্জন করতে হলে সাধনার প্রয়োজন, সেটা একদিনে হয়না। এই সাধনার শুরুটা কোথাও না কোথাও থেকে হবেই আর এর পথটাও কদাচিৎ সরল। এপথে বার বার হোঁচট খেতে হয়, তবেই আসে সাফল্য। শিশু যেমন হোঁচট খেতে খেতে একদিন হাঁটতে শেখে, তারপর দৌড়ে বেড়ায়, ঠিক তেমন হোঁচট খেতে খেতেই সব কিছু শিখতে হয়, বড় হোক বা ছোট। আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাও এই তত্ত্বটা সমর্থন করে। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন মানুষের মস্তিষ্ক দেহের অন্যান্য যে কোন পেশির মত গড়ে উঠতে পারে বারংবার ব্যায়াম অর্থাৎ চেষ্টার মাধ্যমে।

পৃথিবীতে যত সফল মানুষ আছেন তারা বেশিরভাগই উন্নতির মানসিকতা ধারণ করেন। তারা কেউ অতিমানব নন। যারা সফল তাদের সাথে আমাদের সাধারণত পরিচয় ঘটে তাদের সফলতা প্রপ্তির পরেই, এর আগের ইতিহাস আমরা জানিনা। একজন বিখ্যাত গায়ক স্টুডিও থেকে স্টুডিওতে ধর্ণা দিয়ে কত কষ্টে প্রথম গান রেকর্ড করার সুযোগ পেয়েছেন, এধরণের গল্প মাঝেমাঝে আমাদের অবাক করে দেয়। কিন্তু তিনি কত বছর সাধনা করে এত ভাল গাইতে শিখেছেন, সে খবর আমরা জানিনা। একইভাবে একজন বিজ্ঞানীর একটা সফল আবিষ্কারের পেছনে কত ব্যর্থ পরীক্ষা আছে, একজন প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতিবিদের একটা সন্দর্ভ ভাল জার্নালে ছাপা হলে বাকি কতগুলো সন্দর্ভ কখনো আলোর মুখ দেখেনা, একজন ভাল পিয়ানোবাদক দিনে কতঘন্টা রেওয়াজ করেন, সেসব আমাদের জানার সুযোগ হয় কম। তাই অবচেতনভাবে আমরা ভাবতে শুরু করি যে পৃথিবীর বেশিরভাগ সফল ব্যাক্তির সাফল্য অনায়েসে এসেছে, এর পেছনে ছিলনা কোন ব্যর্থ তা। তাই আমার সাফল্য যদি অনায়েসে না আসে, তার মানে আমার হয়তো যোগ্যতাই নেই সফল হওয়ার। এটা পুরোপুরি একটা ভুল ধারণা।

মুশকিলটা হচ্ছে আমাদের সমাজে বাচ্চারা যে পরিবেশে বড় হয়, তাতে তাদের উন্নতির মানসিকতার বদলে স্থির মানসিকতা গড়ে ওঠার প্রবণতা থাকে বেশি। ব্যর্থতা বিষয়টাকে আমাদের সমাজে খুব নিচুচোখে দেখা হয়। আমরা ক্লাসের ফেল্টু ছেলেটাকে নিয়ে হাসাহাসি করি। আবার যে ছেলে দিনরাত পড়ে ভালো ফল করে তাকে নিয়েও হাসাহাসি করি। বলি, ব্যাটা ছাগল দিনরাত খালি পড়াশুনা করে। যেন বেশি চেষ্টা করে কিছু করাটা একটা বোকামি। আবার যে ভান করে পড়াশুনা না করেই ক্লাসে প্রথম হচ্ছে, তার দিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকি। অনেক বাবামা নিজের অজান্তে সন্তানের উন্নতির মানসিকতাটা ধীরে ধীরে নষ্ট করে ফেলেন। বাচ্চা যখন বড় হতে থাকে, তখন তার ছোটোছোটো সাফল্যগুলো এমনভাবে বাবামা উদযাপন করেন যে বাচ্চাদের মধ্যে একটা ধরণা গড়ে ওঠে যে খুব সহজেই বাহবা পাওয়া যায়। আবার যখন বাচ্চা আরেকটু বড় হয়ে ওঠে, স্কুলে একটু খারাপ ফল করলেই বাবামা বাচ্চাকে বকাঝকা করেন। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাও একই কাজ করেন। বাচ্চা পড়াশুনার বাইরে কোনো একটা বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠলে যদি সেক্ষেত্রে খুব একটা ভালো করতে না পারে, বাবামা বলেন অযথা সময় নষ্ট করিসনা। ওটা বাদ দিয়ে অন্য কিছু কর। আরেকটু বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যদি একটু কম বুদ্ধিমান বাচ্চা কঠিন একটা বিষয় নিয়ে পড়তে চায়, সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে - পারবিনা পারবিনা, সহজ কিছু একটা পড়। মধ্যবিত্ত বাড়ির একটা ছেলে ব্যবসা শুরু করতে চাইলে সবাই আতংকিত হয়, ব্যবসায় লালবাতি জ্বলবে।

মোটকথা, এসব অভিজ্ঞতার ফলে বাচ্চাদের মনে আস্তেআস্তে একটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হতে থাকে যে ব্যর্থতা খুব খারাপ জিনিষ, জীবনে সফল হতেই হবে। ব্যর্থতার ভয়ে তারা কোনোরকম ঝুঁকি নিতে ভয় পায়, নতুন কিছু শিখতে বা শুরু করতে গিয়ে দোটানায় থাকে, একটু আটকে গেলেই হাল ছেড়ে দেয়। তাই ঠেকে ঠেকে শেষপর্যন্ত একটা কিছু শেখা বা সফল হওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের হয়না। সেকারণে তারা ভাবতে শুরু করে যে সাফল্যটা আসতে হবে অনায়েসে। ভাবে সক্ষমতা এবং বুদ্ধি দুইটাই প্রকৃতিপ্রদত্ত, এর বাইরে খুব বেশি যাওয়া যায়না।

শিশুদের ভেতরে উন্নতির মানসিকতা গড়ে তুলতে বাবমা কিকি করতে পারেন? প্রথমত, আপনারা নিজেরাই তাদের জন্য উন্নতির মানসিকতার উদাহরণ হয়ে উঠতে পারেন। সবসময় নতুন কিছু শেখার বা করার চেষ্টা করতে পারেন, ব্যর্থ হয়েও হাল না ছেড়ে দিয়ে। তাদের সামনে কখনই বলবেন না, আমার দ্বারা এ হবেনা, আমি এই কাজটা পারিনা, ইত্যাদি। শিশুরাতো বড়দের নকল করতে করতেই শেখে, আপনার উন্নতির মানসিকতাটাও শিখে নেবে।

শিশুরা ভুল করলেও তাদেরকে উৎসাহিত করুন ‘ভুল করতে’। কিছু একটা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে আবার চেষ্টা করতে বলুন। যাতে সে বুঝতে পারে ভুল করতে করতেই মানুষ শেখে, ভুল হতেই পারে, ব্যর্থ হতে হতেই একসময় সাফল্য আসে। ব্যর্থতার ভয়টা কেটে গেলে তারা নতুন কিছু চেষ্টা করতে পিছপা হবেনা। চ্যালেঞ্জের সামনে ভয়ে মিইয়ে যবেনা, বরং চ্যালেঞ্জটাকে নিজেকে আরো দক্ষ করার সুযোগ হিসাবে নেবে।

সহজ পথে না হেঁটে তাদের কঠিন পথটা বেছে নিতে অনুপ্রাণিত করুন। ব্যপারটা অনেকটা লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি ব্যবহার করার মত। সবসময় লিফট ব্যবহার করলে পায়ের পেশী কখনই শক্তিশালী হবেনা, কিন্তু দিনের পর দিন সিঁড়ি ভাঙ্গলে হবে। মস্তিষ্কও পায়ের পেশির মতই। কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালে মস্তিষ্কও শক্তিশালী হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখতে চাইলে তাকে স্টাফ নোটেশান অনুযায়ী শিখতে উৎসাহ দিন। অংক হোক বা বাংলা, যেকোন বিষয়ের গভীরে যেতে শেখান।

সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, তাদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করুন, কাজের ফলাফলটাকে গুরুত্ব একটু কম দিন। এটা খুব কঠিন কাজ। ছোট্ট বাচ্চাটি যখন নতুন নতুন জিনিষ শিখে আমাদের চমকে দেয়, তখন কার না ভালো লাগে। তবে এর মাত্রাটা একটু কমিয়ে আনতে হবে। ধরুন, আপনার সন্তানটি একটা অনুষ্ঠানে বেহালা বাজিয়ে অনেক হাততালি পেলো। সেটাকে আপনি যতটুকু প্রশংসা করবেন, তারচে বেশী প্রশংসা করুন সে যখন রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বেহালাটা বাজানোর চর্চা করে। তুমি খুব বুদ্ধিমান, তুমি খুব চালাক, তুমি কত তাড়াতাড়ি শিখতে পারো, তুমি এটা খুব ভালো পারো, ওই কাজে তোমারে স্বাভাবিক দক্ষতা আছে, এধরণের প্রশংসা বাচ্চার সামনে একেবারেই করবেননা। বরং বলুন, বাহ তুমি তো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছ, বা আমি খুশি হয়েছি যে তুমি ব্যর্থ  হয়েও হাল ছেড়ে দাওনি, ইত্যাদি। পরীক্ষায় খারাপ করলেও তার চেষ্টাটাকে গুরুত্ব দিন, একদম বকাবাদ্যি করবেননা।

ক্যারল ডওয়াকের কথা দিয়েই শেষ করছি। “বাবামা যদি বাচ্চাকে শেখাতে পারেন চ্যালেঞ্জ ভালোবাসতে, ভুল বা ব্যর্থতাকে ভয় না পেতে, চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার প্রকৃয়াটা উপভোগ করতে এবং সারা জীবন ধরে শিখতে চাওয়ার ইচ্ছেটাকে বজায় রাখতে, সেটা হবে বাচ্চার জন্য বাবামার সবচেয়ে বড় উপহার।